গত ১৮ মার্চ থেকে লকডাউনে আছে দেশটি। ফলে দেশটির জনগণের পাশাপাশি বাসায় বসে অবরুদ্ধ দিন কাটাচ্ছেন প্রায় ছয় লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি। এখনো পর্যন্ত সুস্থ আছেন প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকরা। মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাদ দিয়ে মালয়েশিয়ার পত্রিকায় সংবাদে দেখা যায় আজ পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সবাই মালয়েশিয় নাগরিক।
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাই কমিশনের শ্রম কাউন্সেলর-২ মো. হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডলের কাছে দেশটিতে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক আক্রান্ত হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি করোনাভাইরাস সংক্রান্ত মালয়েশিয় ওয়েবসাইটের বরাদ দিয়ে বলেন, “মালয়েশিয়ায় আক্রান্তদের নাগরিকত্ব হিসেবে মালয়েশিয় দেখানো হয়েছে সবাইকে। তার মানে এখনো মালয়েশিয়ায় অন্য দেশের কেউ আক্রান্ত হয়নি।”
লকডাউনে কেমন আছেন প্রবাসীরা:
মালয়েশিয়ায় প্রথম দফায় লকডাউন ঘোষণা করা হয় ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ। পরে সরকারের এক ঘোষণায় লকডাউনের সময় বাড়ানো হয়েছে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। লকডাউন অবস্থায় কেমন আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানতে চেয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা একাধিক বাংলাদেশির সঙ্গে।

কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা কোতারায়ার বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতা রাশেদ বাদল। তিনি বলেন, “লকডাউনের পর থেকে কোতারায়ায় বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। শুধু কয়েকটা শাকসবজি ও মুদির দোকান খোলা আছে। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশিরা ভালো আছেন। লকডাউনের কারণে কারো খাওয়া-দাওয়ার কোন সমস্যা হচ্ছে এমন খবর এখনো আমরা পাইনি। সামনের দিনগুলোতে কী হবে বলা যাচ্ছে না। আমরা ফোনে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়মিত খবরাখবর নিচ্ছি।”
সবজি বাগানের কাজ সীমিত আকারে আর মুদির দোকানের কাজ ছাড়া বাকি সব কাজ এ লকডাউনে বন্ধ আছে বলে জানান রাশেদ বাদল। তিনি বলেন, “আমরা ফোনে, ফেইসবুক গ্রুপ ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে লকডাউনে মালয়েশিয় সরকারের ঘোষিত নিয়মকানুন মেনে চলার জন্য প্রবাসীদেরকে সচেতন করছি।”
কোতা দামানসারা এলাকায় আসবাবপত্র বিক্রয়কেন্দ্রের সেলসম্যান হিসেবে কাজ করেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, ১৮ মার্চ থেকে গৃহবন্দি আছেন তিনিসহ ওই এলাকায় (দামানসারা) কর্মরত কয়েক হাজার বাংলাদেশি। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও কাঁচাবাজার করতে তারা মাঝে মাঝে নিকটস্থ সুপারমার্কেটে যান দুই-একজন। একসঙ্গে কয়েকজন বের হলে পুলিশ বা সেনা সদস্যদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে খাওয়া-দাওয়ায় কোন সমস্যা হচ্ছে না।
তার মালিক লকডাউন সময়ের বেতন দিবেন কিনা এখনও জানেন না তিনি। তবে খাওয়া খরচের টাকা দেন বলে জানান সাহাবউদ্দিন।
বগুড়ার গোলাম মোরশেদ থাকেন শিল্পকারখানা অধ্যুষিত তামিং জায়া এলাকায়। তিনিও জানালেন ১৮ তারিখ থেকে সেখানে সব বাংলাদেশি কর্মী বাসায় অবস্থান করছেন। সেখানে শাকসবজি, মাছ-মাংস ও মুদির দোকান খোলা আছে। এসব দোকানে কেনাকাটা করার প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাসা থেকে বের হন না।
পেরাক প্রদেশের শ্রি রায়া একালায় কাজ করেন জোটন দাস। তিনি জানান, পেরাকের এ এলাকায় শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন কাজ করেন বিশ-পঞ্চাশ হাজার বাংলাদেশি। তাদের সামাজিক সংগঠন ‘প্রবাসী পরিবার ঐক্য পরিষদ’ এর সদস্যরা বাংলাদেশিদের খবরাখবর নিচ্ছেন। সেখানে সবাই এখন যার-যার বাসায় সময় কাটাচ্ছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা শাকসবজি, মাছ, মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হোম ডেলিভারি দিচ্ছেন বাংলাদেশি প্রবাসীদের বাসায় বাসায়।
এ লকডাউন অবস্থায়ও প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কাজ করছেন চট্টগ্রামে ছেলে নাজিম খান। তিনি কাজ করছেন মালয়েশিয়ার বাণিজ্যিক শহর বুকিং তিনতাং এলাকায় চেইন সুপারসপ ‘সেভেন ইলেভেনে’। সঙ্গে কাজ করেন আরো তিন বাংলাদেশি। প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন আলাদা আলাদা মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস ও হ্যান্ড সেনিটাইজার দেওয়া হয় তাদের।
তিনি জানান, বাংলাদেশি অধ্যুষিত বুকিং বিনতাং এ ‘সেভেন ইলেভেন’, ‘কেকে’, ‘নাইনটি নাইনের’ মতো চেইন সুপারশপগুলো ও বাংলাদেশি মুদির দোকানগুলো খোলা রয়েছে। খোলা থাকে সকাল সাতটা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত। প্রবাসীরা এসে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নেন এখান থেকে।
টাইম স্কয়ারের ব্যবসায়ী চট্টগ্রামের ছেলে নাছির খান। তিনি জানান, তিনিসহ তার দোকানের স্টাফরা সবাই বাসায় বসে দিন কাটাচ্ছেন খেয়ে, ঘুমিয়ে, প্রার্থনা করে। তিনি জানেন না ভবিষ্যতে কিভাবে কাটিয়ে উঠবেন করোনার কারণে ব্যবসা বন্ধের এ ক্ষতি।
সাভারের ছেলে সানোয়ার হোসেন নেগেরি সেমবিলান প্রদেশের প্রধান শহর সেরেমবান থেকে জানান, সেখানে এখনো বাংলাদেশি প্রবাসীদের কোন সমস্যার কথা শোনেনি তিনি। সেলাংগর প্রদেশের ছিমোনিয়া থেকে হবিগঞ্জের নুরুল আমিন জানান, তাদের এলাকায় বাংলাদেশি দোকানগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম একটু বাড়তি। এছাড়া আর কোন অসুবিধা নেই সেখানে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুবল চন্দ্র বণিক ব্যবসা করেন চায়নাটাউনে, থাকেন চেরাস এলাকায়। তিনি বলেন, “ভাল আছি ভাই, তবে কতদিন নিরাপদ থাকব বলা যাচ্ছে না। দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের জন্যও টেনশন হয় খুব। কবে যে এ মহামারির দিন শেষ হবে।” জহুর প্রদেশ থেকে নারায়ণগঞ্জের তরিকুল ইসলাম আমিন জানান, সেখানে বাংলাদেশিরা ভালো আছেন। এখনো পর্যন্ত কারো কোনো সমস্যা হয়নি।
অগ্রণী ব্যাংক মালিকানাধীন ‘অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউসের’ প্রধান কার্যনির্বাহী খালেদ মোরশেদ রিজভী জানান, ১৮ মার্চ থেকে অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউসসহ সব রেমিট্যান্স হাউস বন্ধ আছে। মালয়েশিয় সরকার ঘোষণা দিয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হবে। তার মানে প্রতিষ্ঠানের খরচ চলামান রয়েছে, কিন্তু আয় নেই। দেশেও কোন রেমিট্যান্স যাচ্ছে না এসময়ে।
হাই কমিশনের শ্রম কাউন্সেলর-২ মো. হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ফোনে প্রবাসীদের খবর নিচ্ছি। অনেকেই আমাদের ফোন নম্বরে কল করে, মেসেঞ্জারের মেসেজ করে তাদের অবস্থা জানাচ্ছেন। বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিচ্ছেন। প্রতিটি প্রদেশে যোগাযোগ আছে আমাদের।”
লকডাউনে কাজ বন্ধ সময়ের কর্মীদের বেতন দেবেন কিনা মালয়েশিয় মালিকরা এ প্রশ্নে হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল জানান, বেতন দেওয়ার জন্য মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় কড়া নির্দেশ দিয়েছে। যদি কেউ বেতন না দেয় তাহলে লেবার অফিসে জানতে বলেছে। প্রমাণ পেলে কঠোর শাস্তি দিবে বলে জানিয়েছে।
এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাই কমিশনের সব ধরণের কনস্যুলার সেবা স্থগিত আছে। তবে এসময় শুধু অতি জরুরি ও অত্যাবশকীয় প্রয়োজনে অফিস চলার সময়ে মিশনের নম্বরে যোগাযোগ করে দূতাবাসের সেবা গ্রহণ করা যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে দূতাবাসের এক নোটিশে।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |