ওই ভবনগুলোর বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে রাজউকের পক্ষ থেকে
বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটিও করা হয়। সেই কমিটি
কয়েকটি সুপারিশও করেছিল,
যার বাস্তবায়ন না হওয়ায় অসন্তোষ জানিয়েছেন কমিটির সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক
মেহেদী আহমেদ আনসারী।
সুপারিশগুলোর কোনো ‘ফলোআপ’ নেই জানিয়ে
তিনি বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অক্টোবরে কমিটি গঠনের পর শেষ গত
বছরের ডিসেম্বরে বৈঠক হয়েছে।
কমিটির বৈঠকও হয় না। আমরা যে রেজ্যুলেশন নিয়েছিলাম
ভবনগুলোর রিঅ্যাসেস করে প্রতিটি ভবনকে আলাদা করে দেখতে হবে যে তার ভার বহন করার
ক্ষমতা আছে কি না। ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ঠিক আছে না কি অপ্রতুল।
সেটাতো করা হয়নি।”
ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা বাড়াতে কী করণীয় সে বিষয়ে কিছু
সুপারিশ করেছিলেন কমিটির আরেক সদস্য বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ
হেলালী।
তিনি বলেন, “অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী কী করতে হবে, কীভাবে
করতে হবে সে বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিলাম।
সেটার কোনো আপডেট বা ফলোআপ কিছুই নাই। ভবনের
অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন জরুরি।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবস্থা
নিতে ভবন মালিকদের তিন মাস সময় দিয়েছিলেন তারা।
সেই সময় অনেক আগে পেরিয়ে গেলেও কাজগুলো হয়েছে কি না, তা আর খতিয়ে দেখা হয়নি।
এজন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের
সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন তারা।
অপরদিকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভবনের
নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওই সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা ঠিক
করতে আরেকটি কমিটি করেছেন তারা। তাদের এখন
চলছে সেই কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষার পালা।
গত বছরের ২৮ মার্চ ২৩ তলা এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে
২৭ জন নিহত হওয়ার পর এই ভবন নির্মাণে নানা অনিয়মের বিষয়গুলো বেরিয়ে আসতে থাকে। কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে ওই ভবনের জমির মূল
মালিক ছিলেন প্রকৌশলী এসএমএইচআই ফারুক।
অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভবনটি নির্মাণ করে রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেড।
সে কারণে সংক্ষেপে ভবনের নাম হয় এফআর টাওয়ার।
নকশা জালিয়াতির মাধ্যমে ভবনটিতে কয়েকটি তলা বাড়ানোর অভিযোগে মামলা চলছে।
মর্মান্তিক এই অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউকের কর্মকর্তারা ২৪টি দলে ভাগ হয়ে গত বছরের
১ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকার এক হাজার ৮১৮টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করেন।
১১ তলা বা তার বেশি তলাবিশিষ্ট ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে গণ্য করে রাজউক।
এ সময় প্রায় দুই হাজার ভবন পরিদর্শন করে অগ্নিনিরাপত্তা
ব্যবস্থা না থাকা, নকশার
বাইরে গিয়ে ভবন নির্মাণসহ বেশ কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়।
পরিদর্শনে রাজধানীর বেশিরভাগ বহুতল ভবনেই কোনো না কোনো অনিয়ম পায় কমিটি।
কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিদর্শন করা ভবনের মধ্যে ৫৩৯টিতে
অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র-যেমন ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার অ্যালার্ম, হোজ পাইপ
পর্যাপ্ত পাওয়া গেছে। তবে তার দ্বিগুণের বেশি ভবনে
অর্থাৎ ১ হাজার ১৫৫টিতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র যেমন ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার
অ্যালার্ম, হোজ
পাইপ পর্যাপ্ত ছিল না।
৭৮৬টি ভবনে অগ্নিনির্বাপণ সিঁড়ি যথাযথ পাওয়া গেলেও ব্যত্যয়
পাওয়া গেছে ৭২১টি ভবনে। ৫৬৬টি ভবনে অগ্নিনির্বাপণ সিঁড়িই
ছিল না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
রাজউকের অনুমোদন আছে এমন ভবনগুলোর মধ্যে ২৭৭টিতে ঊর্ধ্বমুখী
ব্যত্যয় আছে অর্থাৎ এসব ভবন নির্ধারিত উঁচ্চতার চেয়ে বেশি তলা নির্মাণ করা হয়েছে।
সেটব্যাক ও অন্যান্য ব্যত্যয় পাওয়া গেছে ৬৭৪টিতে।
রাজউকের বাইরে অন্যান্য সংস্থার অনুমোদিত ভবনের মধ্যে
ঊর্ধ্বমুখী ব্যত্যয় ছিল ৩২টি ভবনে। সেটব্যাক
ও অন্যান্য ব্যত্যয় পাওয়া গেছে ৬৪টিতে। পরিদর্শনের
সময় ৪৭৮টি ভবনের মালিক অনুমোদিত নকশাই দেখাতে পারেনি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
এসব ভবনের বিষয় করণীয় ঠিক করতে গত বছরের অক্টোবরে বুয়েটের
অধ্যাপক, আইইবির
প্রতিনিধি এবং রাজউকের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
সব কিছু যাচাই-বাছাই করে নিয়ম না মানা বা প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকা এসব ভবনগুলোর
বিষয়ে চারটি সুপারিশ করে বিশেষজ্ঞ কমিটি।
এগুলো হচ্ছে- ভবনের কাঠামোগত বিস্তারিত কারিগরি মূল্যায়ন.
ভবনের অগ্নি ও বৈদ্যুতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা করা।
এসব বিষয় ঠিক থাকলে আর্থিক জরিমানার পর ভবনগুলোর অনুমোদন দেওয়া। পরীক্ষায়
ভবনের কাঠামো এবং সুরক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা পাওয়া গেলে ভবন পুনর্নির্মাণ বা
শক্তিশালীকরণ করতে হবে।
কমিটির সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, যেসব ভবন
পরিদর্শন করা হয়েছিল তার ৯০ ভাগেরই কিছু না কিছু ত্রুটি আছে।সেটা
ফায়ার সেফটি হোক বা অন্য কিছুতে।
“যা
যা ব্যত্যয় আছে সেগুলো ঠিক করলেই সেগুলোকে ছাড়পত্র দেওয়া যাবে।
এতগুলো ভবন তো ভেঙে ফেলাও কঠিন। মেরামত
করলে তা ব্যবহার করা যাবে। আমরা সেই
সুপারিশই করেছিলাম।”
ওই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চাইলে রাজউকের
পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১) মো. মোবারক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন ভবনের তথ্য উপাত্ত
সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি ভবনে কী কী সমস্যা আছে তাও প্রতিবেদন
আকারে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
“সমস্যা
চিহ্নিত হওয়া ভবনের মালিকদের নিজ দায়িত্বে সমস্যাগুলো সমাধান করতে বলা হয়েছে।
এজন্য তিন মাসের সময় দেওয়া হয়েছিল, সেটাও অনেক আগে পেরিয়ে গেছে।
রাজউকের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেজন্য মন্ত্রণালয়ের
সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। এসব ভবনের
ব্যাপারে করণীয় কী সে সিদ্ধান্ত এখনও দেওয়া হয়নি।
সিদ্ধান্ত জানালে আমরা সে অনুযায়ী কাজ করব।”
বিষয়টির অগ্রগতি জানতে চাইল গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের
সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সুপারিশগুলো
বাস্তবায়নের জন্য রাজউক,
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
“বিষয়গুলো
কীভাবে কী করা যায় তা দেখার জন্য। কমিটির
আরেকটি প্রতিবেদন দেওয়ার কথা।
প্রতিবেদনটি রেডি হয়েছে শুনেছি। আমরা
তাগাদাও দিয়েছি। সেটা পেলে হয়ত ব্যবস্থা নিতে পারব।
কাজটা চলছে। তাদের সুপারিশ পেলে আমরা বাস্তবায়নে যাব।”