ক্যাটাগরি

করোনাভাইরাস: এত ভেন্টিলেটর বিশ্ব পাবে কোথায়?

কিন্তু এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ যুঝে চলা দেশগুলোর হাসপাতালে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জরুরি এই যন্ত্রটি পর্যাপ্ত সংখ্যায় নেই বলেই জানাচ্ছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।

বৃহস্পতিবারের এক প্রতিবেদনে তারা বলছে, এই সময় ভেন্টিলেটর সঙ্কট মানুষের বেঁচে থাকাকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলবে। 

নভেল করোনাভাইরাসে বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যার মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় ভেন্টিলেটর সেবা বাড়াতে কী করা যায়, সে উপায়ই খুঁজছে এখন সব দেশ।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি রোগীর শহর নিউ ইয়র্কের মেয়র বিল ডে ব্লাসিও জানিয়েছেন এই সময়ে সেখানকার চাহিদার কথা; রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিতে ১৫ হাজার ভেন্টিলেটর প্রয়োজন পড়বে তার। 

কিছু গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসে জানাচ্ছে, তারা এই যন্ত্র বানিয়ে দিতে সহায়তা করবে।

সাধারণত কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে মৃদু অসুস্থতাই দেখা যায়। এদের মধ্যে শতকরা ৬ জনের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ছে বলে উল্লেখ করেছে গার্ডিয়ানের ওই প্রতিবেদন; আর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বয়স্করাই।

ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্নস সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড ক্রিটিকাল কেয়ারের উপ-পরিচালক অধ্যাপক ডেভিড স্টোরি গার্ডিয়ানকে বলেন, ভেন্টিলেটর ছাড়া রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না; আর এখনকার এই চাহিদার কারণেই ভেন্টিলেটর ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। 

লাং ফাউন্ডেশন অস্ট্রেলিয়ার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং মেলবোর্নের দ্য রয়েল চিলড্রেনস হসপিটালের রেসপিরেটরি অ্যান্ড স্লিপ মেডিসিনের পরিচালক অধ্যাপক শরথ রঙ্গনাথন শোনালেন আশঙ্কার কথা।

“ইতালি ও স্পেনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিসংখ্যান মেলালে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে যাদের অবস্থা গুরুতর হবে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না।

“যেসব রোগীকে হয়ত সুস্থ করে তোলা যেত, কিন্তু ভেন্টিলেটর ছাড়া তাদের বাঁচানো যাবে না,” বলেন তিনি।

ভেন্টিলেটর কীভাবে কাজ করে?

বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চিকিৎসা ক্ষেত্রে দুই রকমের ভেন্টিলেটর সেবা দেওয়া হয়; একটি মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর এবং অন্যটিকে বলা হয় নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর।

মাস্ক ও অক্সিজেন ট্যাংক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে আনার এই চিকিৎসাটি নন-ইনভেসিভ পদ্ধতি বলে পরিচিত।

অনেক ভেন্টিলেটর কক্ষের আর্দ্রতা স্বাভাবিক রাখতেও কার্যকর; এটা রোগীর শরীরের তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাপমাত্রা বাড়ায় বা বাতাসকে আর্দ্র রাখতে পারে।

ভেন্টিলেটর ব্যবহারের সময় রোগীকে ওষুধ দেওয়া হয়, যাতে করে তার শ্বাসতন্ত্রের পেশী স্বাভাবিক থাকে এবং যন্ত্রের মাধ্যমে ফুসফুস সহজেই অক্সিজেন নিতে পারে।

যাদের মৃদৃ অসুস্থতা আছে তাদের মুখে বা নাকে মাস্ক লাগিয়ে ফুসফুসে অক্সিজেন পাঠানো হয়।

ভেন্টিলেটর কখন জরুরি?

রোগীর শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তীব্র হলে ফুসফুসে পানি জমে শ্বাস নেওয়া কষ্টকর করে তোলে। কারণ এসময় রোগীর শরীর প্রয়োজনীয় অক্সিজেন টেনে নিতে পারে না।

অক্সিজেনের এই অভাব পূরণে ভেন্টিলেটর ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে ফুসফুসে বাতাস সরবরাহ করা হয়। 

কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র সেবা দেওয়ার আগে চিকিৎসকরা আগে পরীক্ষা করে দেখেন ওই রোগী শ্বাসযন্ত্র স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছে কি না। 

অধ্যাপক শরথ বলেন, “শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, রোগীকে অস্থির দেখায়; কারণ এসময় রক্তে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়ায় তাদের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে এবং তারা অচেতন হতে পারে।”

সুস্থ অবস্থায় মানুষ প্রতি মিনিটে ১৫ বার শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। কিন্তু যদি কেউ মিনিটে ২৮ বার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে থাকেন তবে এসময় তাকে ভেন্টিলেটর দেওয়া জরুরি হয়ে উঠতে পারে।

তবে ভেন্টিলেটর দেওয়ার আগে রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করাকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন রয়েল অস্ট্রেলেসিয়ান কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড রেসপিরেটরি ফিজিশিয়ানের সভাপতি অধ্যাপক জন উইলসন।

স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেক সময়ই নন-ইনভেসিভ পদ্ধতি ব্যবহার করতে চান না। তাদের আশংকা, কোভিড-১৯ রোগীর কফ বা কাশির সম্ভাবনা তখনও থেকে যায় বলে চিকিৎসা সেবা দিতে আসা স্বাস্থ্যকর্মীর মাঝেও সংক্রমণ ঘটাবে।

তবে যখন একজন চিকিৎসক মনে করেন যে রোগীর ভেন্টিলেটর প্রয়োজন, এর অর্থ ‘অতি দ্রুত ভেন্টিলেটর সেবা দিতে হবে’ বলে জানাচ্ছেন রঙ্গনাথন। 

তিনি বলেন, “অক্সিজেন দিয়ে খুব বেশিক্ষণ রোগীকে সুস্থ রাখা সম্ভব হয় না। রোগীর শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে সাধারণত ৩০ মিনিটের বেশি ভেন্টিলেটর দেওয়া যায় না।”

গবেষণা বলছে, যদি একজন কোভিড-১৯ রোগী যদি অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রমের কারণে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে তবে ওই সময় সামান্য পরিমাণ অক্সিজেন ও বাতাস ঘন ঘন সরবরাহ করতে হবে।  

একজন রোগীকে প্রয়োজনে টানা কয়েক সপ্তাহ ভেন্টিলেটর সেবা দিতে হতে পারে।

যেহেতু ভেন্টিলেটর যন্ত্রের একটি টিউব গলা দিয়ে নিচে নেমে যায়, তাই এই প্রক্রিয়াটি সহজ করতে ট্রাকিওস্টমি করা হয়ে থাকে অনেক সময়। কণ্ঠনালীর নিচে অস্ত্রপচার করে সেখান দিয়ে নলটি সরাসরি প্রবেশ করানো হয়।

গবেষণার বরাতে গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, এই পদ্ধতিতে রোগী বেশি সজাগ থাকেন; আর অস্ত্রোপচারে করা ওই ছিদ্র কোনো শারীরিক সমস্যাও তৈরি করে না ।

ভেন্টিলেটর ঘাটতি পূরণ কী করছে বিশ্ব? 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে যুক্তরাজ্যের সরকার ইতোমধ্যে ১০ হাজার ভেন্টিলেটর নিতে যাচ্ছে ডাইসন থেকে বলে জানাচ্ছে বিবিসির বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদন। 

ডাইসনের প্রধান ব্রিটিশ উদ্ভাবন জেমস ডাইসন বিবিসিকে বলেন, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) জন্য তারা নতুন ধরনের ভেন্টিলেটর নির্মাণ করেছেন।  

প্রতিষ্ঠানটির শত শত প্রকৌশলী নতুন এই যন্ত্রের পেছনে কাজ করে চলেছে।

যদিও নতুন এই যন্ত্র এখনও মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে ছাড়পত্র পায়নি, তবে এসব প্রক্রিয়া শিগগিরই করা হবে বলে জানাচ্ছে বিবিসি।

কোভিড-১৯ যেন মানুষের মাঝে আরো ছড়িয়ে পড়তে না পারে তা নিশ্চিত করাকেই এই সময় ভেন্টিলেটর সঙ্কট এড়ানোর একটি সহজ পন্থা বলে জানাচ্ছে গার্ডিয়ান।

আর এজন্য স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে পুরোপুরি; পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ান হেলথ কেয়ার অ্যান্ড হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশন, দ্য অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউ জিল্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার সোসাইটির পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার শিল্প মন্ত্রী কারেন অ্যান্ড্রিউসও মনে করছেন, ভেন্টিলেটরের এই ঘাটতি এড়ানো সম্ভব। 

অস্ট্রেলিয়ার সরকার পরীক্ষা করে দেখছে প্রাণিদের চিকিৎসায় যে ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা হয় তা কোনোভাবে উন্নত করে কোভিড-১৯ রোগীদের সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় ব্যবহার করা যায় কি না।

ঘুমের মধ্যে বারবার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ ও খোলার সমস্যায় ভোগা রোগীদের জন্য স্লিপ অ্যাপনিয়া মেশিন ও অ্যানেসথেটিক মেশিন ব্যবহার করা কতটুকু সম্ভব, তাও ভেবে দেখা হচ্ছে।

অ্যাম্বুলেন্সে যে ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা হয়, সেটাও একটি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

উইলসন বলেন, “স্বাস্থ্যকর্মীরা যারা মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ, তারা এই মুহূর্তে বেশ উদ্বিগ্নই; যদি কোভিড-১৯ আক্রান্তদের শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা বাড়তেই থাকে, তবে তারা কতটুকু সেবা দিয়ে যেতে পারবেন, এই পরিস্থিতিতে সেটাই ভাবনার বিষয়।”

পরিস্থিতি কতটুকু গুরুতর হতে পারে তা বোঝাতে তিনি বলেন, “এটা হতে পারে যে অনেককেই ভেন্টিলেটর সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।

“সীমিত সুযোগের এই সময় স্বাস্থ্যকর্মী, পরিবার এবং রোগীকে হয়ত এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। এখানে অনেক নৈতিক দ্বন্দ্ব আছে; আর এটা এত সহজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কোনো অবস্থাও নয়।”