কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চেনা সেই চিত্র এখন নেই; বেসরকারি এই হাসপাতালগুলো প্রায় রোগীশূন্য, রোগ নিরূপণ কেন্দ্রগুলোতেও নেই ভিড়।
হাসপাতাকর্মীরা বলছেন, রোগীর সংখ্যা যেমন কমে গেছে, তেমনি চিকিৎসকরা চেম্বারে বসছেনও কম।
করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে সাধারণ ছুটির পর বাইরে না বের হওয়ার নির্দেশনায় সবাই এখন ঘরবন্দি।
এর মধ্যেই শনিবার বিকালে মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে ধানমণ্ডির বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে এগুলো খাঁ খাঁ করতে দেখা গেছে; যদিও জরুরি সেবা কেন্দ্র হিসেবে সবগুলোই রয়েছে খোলা।
বিকালে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে প্রথমেই কথা হয় বাইক রাইডার আলমাস খানের সঙ্গে; সকাল ৯টায় বেরিয়ে বিকাল ৫টা নাগাদ মাত্র দুজন যাত্রী পেয়েছেন তিনি।
আলমাস বলেন, “অ্যাপ বন্ধ। কিন্তু পেট তো বন্ধ নাই। খেতে হবে। এজন্যই ঝুঁকি নিয়ে বের হওয়া। আয় হয়েছে মাত্র তিনশ টাকা।”
পাওয়া গেল অটোরিকশাচালক আাজিজুর রহমানকে। তার একজন নির্ধারিত রোগী আছে। তাকে হাসপাতালে আনা-নেওয়ার জন্য তার বের হওয়া। এই ফাঁকে যদি ট্রিপ পান, তাও নেন।
নুর হোসেন নামে আরেক আটেরিকশাচালক বললেন, “পেটের দায়ে বের হয়েছি ভাই।”
বাসস্ট্যান্ডের পাশেই পুলিশ বক্স। ভেতরে বসা সার্জেন্ট আবু জাফর জানালেন, কোনো কাজ নেই।
আল মানার হাসপাতাল
মোহাম্মদপুর থানার পাশে হাসপাতাল। ঢোকার অগেই স্যানেটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করিয়ে নিল। জুতার তলায় জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটিয়ে দেওয়া হল। সবাইকেই দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালে ঢুকতেই কথা হল কাস্টমার কেয়ারের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. নাইম হাসানের সঙ্গে।
তিনি বললেন, “বিশেষাজ্ঞ ডাক্তারদের চেম্বার অধিকাংশই বন্ধ। তবে হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ডাক্তার আছেন। রোগী আসছে, ভর্তিও করা হচ্ছে। তবে ৯০ ভাগ কমে গেছে। সারা দিনে প্রায় ১৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।”
সর্দি-জ্বর নিয়ে কেউ এলে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ আই হাসপাতাল
ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কের মাথায় এই হাসপাতালে ঢুকতেই যথারীতি স্যানেটাইজার দেওয়া হল। মুখে মাস্ক আর হ্যান্ড গ্লাভস পরা কাস্টমার কেয়ারের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান জানালেন, রোগীর সংখ্যা অনেক নেমে এসেছে। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ রোগী হত, সেখানে মাত্র ৩৪ জন এসেছে।
প্রতিদিন এই হাসপাতালে প্রায় ৩০জন চিকিৎসক বসেন। শনিবার বসেছেন মাত্র পাঁচজন।
জরুরি রোগীর জন্য তারা ২৪ ঘণ্টাই হাসপাতাল খোলা রেখেছেন বলে জানান হান্নান।
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ধানমণ্ডি শংকরের পাশে এই হাসপাতালের গেটে অনেকক্ষণ থাকার পরেও কোনো রোগী ঢুকতে দেখা গেল না। আশেপাশেও নেই আগের মতো জটলা। এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের নেই কোনো ছোটাছুটি, হৈ চৈ বা আড্ডা। চারদিক নিস্তব্ধ। তবে জরুরী বিভাগ খোলা আছে। নিরপত্তার কর্মীদের শুধু মুখে মাস্ক ছাড়া আর কোন কিছু দেখা গেলো না।
ভেতরে হাত ধুয়ে ঢুকতে হল। চিকিসৎকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে একজন নিরাপত্তাকর্মী জরুরি বিভাগ দেখিয়ে দিলেন।
জরুরি বিভাগে ডা. সত্য রঞ্জন মন্ডলকে পাওয়া গেল, মাথা থেকে পা ধবধবে সাদা পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্টে (পিপিই) ঢাকা। দূরত্ব বজায় রেখে কথা হল তার সঙ্গে।
তরুণ এই চিকিৎসক বললেন, শনিবার তারা ১৫ জন রোগী ভর্তি করিয়েছেন। রোগী অর্ধেক কমে গেছে।
তবে জ্বর কাশি নিয়ে কেউ এলে তার ব্যাপারে সতর্ক থাকছেন জানিয়ে ডা. মন্ডল বলেন, “আজ এমন এজন রোগী এসেছিলেন। তাকে আইইডিসিআরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার
ধানমণ্ডি ৯ নম্বর সড়কের মাথায় এই সেন্টারে সব সময় রোগী বা তাদের আত্মীয়স্বজনে গিজগিজ করে।কিন্তু শনিবার সন্ধ্যার কিছু আগে দেখা গেল একবারে ভিন্ন চিত্র। কর্মীরা নিরাপত্তামূলক পোশাক পরে গল্প করছে, চেয়ারগুলো একবারে শূন্য। ক্যাশ কাউন্টার একাধিক থাকলেও খোলা মাত্র একটি। এই ক্যাশ কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তিকে পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে কাস্টমার কেয়ারে দায়িত্বরত কর্মকর্তা আশরাফুল আলমকে দেখিয়ে দিলেন।
তার সাথে কথা বলতে গেলেই তিনি স্যানেটাইজার বাড়িয়ে দিলেন। হাত পরিষ্কার করে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলতেই সামনে আসনগুলো দেখিয়ে বললেন, “এখানেই আপনার জবাব আছে।”
তিনি জানালেন, ৯০ভাগ রোগী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক না আসায় আলট্রাসনোগ্রাম, ইকোকার্ডিগ্রাম ও ইটিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো স্বল্প পরিসরে চালু আছে।
পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার
ধানমণ্ডি ২ নম্বর সড়কে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঢুকতেই হ্যাক্সিসোল দিয়ে দুই দফা হাত পরিষ্কার করতে হল। সেই সাথে জ্বর মাপার যন্ত্র দিয়ে শরীরে তাপ মেপে নিল। তাপ মাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাট হওয়ায় ভেতরে যাওয়ার সুযোগ মিলল।
কাস্টমার কেয়ারে বসে থাকা চিরঞ্জীব নামের একজন ফোনে কথা বলছিলেন। কথা শেষ হতে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তথ্য জানতে চাইলে বললেন, তাদের প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ রোগী কমে গেছে। যারা আসছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই নিজেদের প্রয়োজনে পরীক্ষা করাতে আসছেন।
চিরঞ্জীব জানান, তাদের এখানে যে সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বসতেন, তাদের অনেকে এখন আর বসেন না। তবে প্রয়োজন দেখা দিলে চিকিৎসক ডাকা হয়। তারা এসে রোগী দেখে চলে যান। তবে তা খুবই নগন্য।
শনিবার তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া গেল পপুলারে। সেখানে প্রতিদিন ৩০ জনের বেশি চিকিৎসক বসেন।
তবে সব পরীক্ষা চালু আছে বলে জানান চিরঞ্জীব।
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
মিরপুর রোডে এই হাসপাতালে ঢুকেই দেখা গেল নিরাপত্তারকর্মীর হাতে একটি স্প্রে মেশিন। এই স্প্রে মেশিন দিয়ে হাত ধুয়ে দিলেন।
ভেতর ঢুকেই সুনসান নিরবতা। পাশে ফার্মেসিতে একটু কথা শোনা গেলো।
আরেকটু ভেতরে ঢুকে কাস্টমার কেয়ারের মো. সবুজকে পাওয়া গেল, গা এলিয়ে বসে ছিলেন তিনি। পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে একই কথা বলেন তিনিও- “রোগী নাই, ৬০-৭০ ভাগ কমে গেছে। জরুরি বিভাগ খোলা আছে। তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সে রকম নাই।”
এই হাসপাতালে সবসময় শিক্ষার্থী এবং ইন্টার্ন চিকিৎসক দেখা গেলেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও সে রকম কাউকে পাওয়া গেলো না।
ধানমণ্ডি লেকে কিছুক্ষণ
হাসপাতাল ঘুরে ধানমণ্ডি লেকে ঢুকতেই দেখা গেল বৈকালিক ভ্রমণ করছেন কয়েকজন। তাদের একজন মো. জিন্নাত আলী। সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি করেন।
বাড়িতে বন্দি থাকাটা অসহ্য মনে হওয়ায় ঝুঁকি নিয়েই একটু বেরিয়েছেন।
বললেন, “শরীরটাকে তো ঠিক রাখতে হবে। তবে সতর্ক আছি।”
তার স সঙ্গে কথা বলার সময় পাশ দিয়ে দুই নারী-পুরুষ কেডস পরে জোরে জোরে হেঁটে গেলেন। এরকম আরও কয়েকজনকে বৈকালিক ভ্রমণে দেখা গেল।
সীমান্ত স্কয়ার ব্যাংক বুথ
জিগাতলা বিজিবির প্রধান দপ্তরের দেয়াল ঘেঁষে সীমান্ত স্কয়ার শপিং মল। সেখানে ফটকের কাছে ১০টি ব্যাংকের বুথ রয়েছে। সন্ধ্যার কিছু আগে সেখানে গিয়ে টাকা তুলতে কাউকে দেখা গেল না।
এই বুথগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের কেউ কেউ জটলা করে গল্প করছেন। তাদের একজন ইউসিবি ব্যাংক বুথের নিরাপত্তা কর্মী আব্দুল হালিম বললেন, লোকজন আসছে না। সারাদিনে ৪/৫জন এসেছেন।
জালাল উদ্দিন নামে আরেক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, “করোনার কারণে লোকজনের আসা কমে গেছে।”
রাসেল স্কয়ার পুলিশ বক্স
শুক্রবাদে রাসেল স্কয়ারের পাশ ঘেঁষে একটি পুলিশ বক্স। ভেতরে উঁকি দিতেই চেয়ারে বসা এসআই অনুপ নাগ। কলাবাগান থানার এই এসআই জানালেন, সকালে ডিউটিতে নেমে লাজ ফার্মায় আসা ক্রেতাদের সামাল দিতে হয়েছে তাদের। তা ছাড়া তার এলাকায় টহলও দিতে হয়।
তিনি বলেন, “সারাদিনে মামলা করার মতো কোনো অপরাধ হয়নি।”
অথচ অন্য দিনে দুই একটি ঘটনা ঘটত, মামলা হত। সেটা ছিনতাই, চুরি বা অন্য কিছু।
এই পুলিশ বক্সে বসা সার্জেন্ট নুর ইসলাম বলেন, তার কাজ নেই। বসে দিন কাটছে।
লাজ ফার্মা
রাসেল স্কয়ারের কাছে ২৪ ঘণ্টা চালু থাকা লাজ ফার্মায় সন্ধ্যার কিছুটা পর ক্রেতা সেরকম দেখা গেল না। তবে ক্রেতারা কোথায় দাঁড়াবেন, তার একাধিক লাল চিহ্ন দেখা গেল।
লাজ ফার্মার কর্মচারী রাজিব হোসেন জানালেন, তাদের এখানে বর্তমানে স্যাভলন, হ্যান্ড স্যানেটাইজার, হ্যাক্সাসোল, ভিটামিন সি, হ্যান্ড গ্লাভসের চাহিদা বেশি। তাছাড়া হঠৎ করে ডায়াবেটিসের রোগের ওষুধের চাহিদাও বেড়েছে।
স্যাভলন, হ্যান্ড স্যানেটাইজার, হ্যাক্সাসলের কোম্পানিগুলো ‘কোনো অর্ডার নিচ্ছে না’ জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য ক্রেতাদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে তাদের।
হঠাৎ ভিড়, কেন?
লাজ ফার্মা থেকে বের হতেও সালমা, আনোয়ারা, সুফিয়া, বানুসহ ১০/১২ জন নারীকে জটলা করতে দেখা গেলো। তাদের কাছে গিয়ে কারণ এবং নাম জানতেই আরও বেশ কয়েকজন ছুটে এসে তাদের নাম লেখাতে অনুরোধ করলেন।
কিছুক্ষণ কথা বলতেই জানা গেল, তারা কলাবাগান বশির উদ্দিন রোডের লাল ফকির মাজার বস্তিতে থাকেন। আশে পাশের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন প্রত্যেকেই। কিন্তু এই সময়ে গৃহকর্তা তাদের আসতে নিষেধ করায় তারা বিপদে পড়েছে।
সালমা বলেন, বাসায় চাল নেই, তারা শুনেছেন লাজ ফার্মা চাল দেবে। এজন্য তারা এখানে এসেছেন। কিন্তু এখানে এসে সেরকম কিছু দেখছেন না তারা।
সালমাবলেন, তাদের কারও স্বামী আছে, কারও নেই। কারও স্বামী রিকশাচালক। কিন্তু এখন রিকশা নিয়ে বের হলেও যাত্রী না থাকায় কোনো আয় নেই।
‘আমরা বড় বিপদে আছি, আমাদের রক্ষা করেন’- একসঙ্গেই বলে উঠেন তারা সবাই।