সোমবার মেরুং ইউনিয়নের দূর্গম রথিচন্দ্র কার্বারিপাড়ার এই বিশ শিশুকে হাসপাতালে
নেওয়া হয় বলে স্থানীয় ইউপি সদস্য গণেশচন্দ্র ত্রিপুরা জানান।
এ নিয়ে প্রায় একই ধরনের লক্ষণের ২১ শিশুকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। এর
আগে রোববার একজনকে ভর্তি করা হয়েছে।
গত শনিবার এই লক্ষণ নিয়ে এই গ্রামের এক শিশু মারা যাওয়ার পর দেশব্যাপী হইচই
শুরু হয়। তারপর শিশুদের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
তবে এই শিশুদের ঠিক কী রোগ হয়েছে তা পরীক্ষা করা ছাড়া বলা যাবে না বলে মত দিয়েছেন
চিকিৎসকরা।
সেনাবাহিনীর দীঘিনালা জোনের মেডিকেল অফিসার ক্যাপ্টেন আহসান হাবিব নোমান বলেন,
সোমবার সকাল থেকে দূর্গম রথিচন্দ্র কার্বারিপাড়া ও আশপাশের এলাকা থেকে আক্রান্ত শিশুদের
গাড়িতে করে দীঘিনালা হাসপাতালে এনে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
“তাদের মূলত হামের নানা ধরনের লক্ষণ রয়েছে। সেনাবাহিনীর দীঘিনালা জোনের পক্ষ
থেকে রোগী ও তাদের স্বজনদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন
শিশুদের সবার জ্বর, সর্দি, হাঁচি ও কাশি রয়েছে। এর মধ্যে একজনের ডায়রিয়াও হয়েছে।
হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন শিশুদের মধ্যে নয়জনের নাম জানা
গেছে। এরা হলো- পানতই ত্রিপুরা (৯), দীমন ত্রিপুরা (৭), কসেল ত্রিপুরা (৭), কমপেন ত্রিপুরা
(৬), খঞ্জন ত্রিপুরা (৭), মেরিনা ত্রিপুরা (৬), তপেন ত্রিপুরা (৮), অলেন্দ্র ত্রিপুরা
(১৫) ও ধনুচান ত্রিপুরা (১২)।
দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তনয় তালুকদার জানান, দুই দিনে হাসপাতালে
২১ জন শিশুকে আনা হয়েছে। তাদের জ্বর, সর্দি, কাশি ও শরীরে লাল দাগ রয়েছে।
“এছাড়া গত শনিবার ধনিকা ত্রিপুরা (৯) নামে আরেক শিশু জ্বর, কাশি ও শরীরে ঘামাচির
মতো রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সে রথিচন্দ্র কার্বারিপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত।”
তনয় তালুকদার বলেন, “হাসপাতালে আনা শিশুদের আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ‘হাম’
হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। তবে হামের লক্ষণ রয়েছে। এছাড়া আক্রান্ত এলাকায় শিশুদের হামের
টিকা দেওয়ার জন্য আজ (সোমবার) থেকে চিকিৎসদের বিফ্রিং শুরু হয়েছে।”
কয়েকদিনের মধ্যে ঘরে ঘরে সার্চিং করে রোগীদের খুঁজে বের করা হবে জানিয়ে তিনি
বলেন, সম্ভব সবাইকে টিকার আওতায় আনা হবে।
‘গুজবের’ কারণে ধনিকা ত্রিপুরার
মৃত্যু
রথিচন্দ্র কার্বারিপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ধনিময়
ত্রিপুরা বলেন, “গুজবে কান দেওয়ার কারণেই ধনিকা ত্রিপুরার মতো শিশুর অকাল মৃত্যু ঘটেছে।
হাসপাতালে নিয়ে গেলে ‘ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হবে’- এমন সব গুজব শুনে প্রত্যন্ত গ্রামটির
অভিভাবকরা হাসপাতালে নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে হয়ত আমার স্কুলের
ছাত্রী ধনিকা ত্রিপুরাকে বাঁচানো সম্ভব হতো।”
মৃত ধনিকা ত্রিপুরার বড় ভাই তরুণ ত্রিপুরা বলেন, “মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাসপাতালে
নিয়ে যাবার জন্য আকুতি জানিয়েছিল বাপ-মায়ের কাছে। অথচ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কী না কী
হয়; নানা গুজবের কারণে সেদিন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি ধনিকাকে। ধনিকাকে হারানোর পর
আরেক ছোট ভাই অলেন ত্রিপুরাকে অবশেষে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো।”
সন্তানের সাথে হাসপাতালে আসা তাদের বাবা অমিন্দ্র ত্রিপুরা সেই কথা স্বীকার
করেছেন। তবে তিনি অর্থনৈতিক সমস্যার কথাও বলেছেন।
সরেজমিনে সোমবার দুপুরে রথিচন্দ্র পাড়ার একেবারে শেষ সীমানায় গিয়ে দেখা গেছে,
জুমচাষি বাগানচন্দ্র ত্রিপুরার জীর্ণশীর্ণ ঘরের মাটিতে তার তিন শিশু কাতরাচ্ছিল।

তারা হলো- হংকারতি ত্রিপুরা (৯), সুকাইত ত্রিপুরা (৬) ও লমিতা ত্রিপুরা (৫)।
তাদের প্রত্যেকের জ্বর, কাশি আর শরীরে লাল দানার মত দেখা গেছে।
বাগান চন্দ্র ত্রিপুরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অর্থের অভাবে হাসপাতালে
নিয়ে যেতে পারছেন না তার সন্তানদের।
পাশের আরেকটি পাহাড়ে গিয়ে দেখা যায়, বিনোরকান্তি ত্রিপুরার ১৭ বছরের মেয়ে চনিতা
ত্রিপুরারও জ্বর, কাশি আর শরীরে লাল দাগ। তিনি নানা ‘কুসংস্কারের’ কারণে হাসপাতালে
নিচ্ছেন না মেয়েকে। বাজারের ফার্মিসী থেকে ওষুধ কিনে আনছেন; কিন্তু হাসপাতালে নেবেনা
বলে জানালেন।
ভাইবোনছড়ায় ‘আরও আক্রান্ত’
জেলা সদরের ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে অজ্ঞাত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বলে
জানিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পরিমল ত্রিপুরা।
তিনি বলেন, ইউনিয়নের নবকুমার কার্বারিপাড়া, শ্যামবাড়িপাড়া, আলমনিপাড়া, রবিধন
পাড়া, সুধন্য কার্বারিপাড়া, ভেজাচন্দ্র কার্বারিপাড়ায় অর্ধশতাধিক শিশু অজ্ঞাত রোগে
আক্রান্ত হয়েছে। তাদের অনেকেরই জ্বর, কাশি ও শরীরে লাল লাল দাগ দেখা যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন নুপুর কান্তি দাশ বলেন, কয়েকদিন ধরে দুটি
মেডিকেল টিম ওইসব গ্রামে কাজ করছে। পৃথক মেডিকেল টিমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডা. মিল্টন ত্রিপুরা
ও ডা. অর্নব ত্রিপুরা।
সিভিল সার্জন বলেন, “এই কয়দিনে মেডিকেল টিমের সদস্যরা ৮৭ জন শিশুর চিকিৎসা
দিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু ২/৩ জন শিশুর মধ্যে হামের লক্ষণ ধরা পড়েছে। বাকিরা প্রাথমিক
চিকিৎসায়
সেরে উঠছে। এসব এলাকায় চিন্তিত হবার মতো কিছু ঘটেনি।”
তিনি আরও বলেন, “শিশুরা মূলত অপুষ্টির কারণে অসুস্থ হচ্ছে। এছাড়া গ্রামবাসীর
মধ্যে কুসংস্কার আর হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের কাছে আনতে অনীহা
প্রকাশই বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।”