আমি ডাক্তারি পেশার সঙ্গে জড়িত কেউ নই। তার পরও সারা বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের বর্তমান মহামারির সময় আমার সাধারণ জ্ঞানলব্ধ কিছু কথা এখানে তুলে ধরতে চাই। আশাকরি দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
১) আমি বেশ কিছুদিন আগে থেকে লক্ষ করছি—পৃথিবীর বিষুবরেখা থেকে উত্তরের কর্কটক্রান্তি এবং দক্ষিণে মকরক্রান্তির মাঝে থাকা গ্রীষ্ম প্রধান দেশগুলোতে করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাব দেখা গেলেও সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিশর, আলজেরিয়া, মরক্কো, মেক্সিকো, কিউবাসহ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিষুবরেখা সংলগ্ন স্থানগুলোতে এ ভাইরাস এখনো তেমনভাবে মহামারি আকারে দেখা দেয়নি এবং কোভিড-১৯ জনিত কারণে মৃত্যুর হারও কম। এ বিষয়টির যথার্থতা বিবেচনায় আনার ব্যাপারে বেশ কিছু স্বনামধন্য ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরাও সহমত পোষণ করা শুরু করেছেন। বিষয়টি সত্য হলে আমাদের মতো স্বল্প উন্নত বা গরিব দেশগুলোর জন্য সেটা হবে বিরাট একটি আশীর্বাদ।
২) ডাক্তার, বিজ্ঞানীদের মতে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের ৮০-৮৫ শতাংশ রোগী এমনিতে ভালো হয়ে যায়। বাকি ১৫-২০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়ে। এসব রোগীদের ‘ফাইব্রাসিস’ জনিত কারণে ফুসফুসের কার্যক্রম বন্ধ বা আংশিক বন্ধ হয়ে গেলে তাদের চিকিত্সার জন্য ‘ভেন্টিলেটরের’ (VENTILATOR) প্রয়োজন হয়। ভেন্টিলেটরের সাহায্যে কৃত্তিমভাবে এসব রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ করে ১-২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলে, এসব রোগীদের ২-১ শতাংশ ছাড়া বেশির ভাগ রোগী আরোগ্য লাভ করেন। তা না হলে, ভেন্টিলেটরের সাহায্য ছাড়া, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এই ১৫-২০ শতাংশ রোগীর প্রায় সকলেই মারা যাবেন।
৩) আমরা প্রায়শই ‘আইসিইউ’ (ICU) কথাটি শুনে আসছি। এসব আইসিউর প্রধান যন্ত্র ভেন্টিলেটর। এ যন্ত্রটি চালনা করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘এনেস্থিওলজিস্ট’ (ANESTHESIOLOGIST), নার্স ও সহকারীদের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন উঠবে এ বিষয়ে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু? আমার জানা মতে, ‘কোভিড-১৯’ মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত আইসিইউ বেড আমাদের দেশে নাই এবং শীত প্রধান দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও যদি এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে অসংখ্য আইসিইউ বেড তৈরি করে এসব রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা একটি দুরূহ বা অসম্ভব কাজ হবে বলেই আমার নিজস্ব ধারণা।
আমার জানামতে, দেশে ১ হাজারের বেশি এনেস্থিওলজিস্ট ডাক্তার আছেন। নার্স এবং সহযোগীদের সংখ্যাও কম নাই। এদের মধ্য থেকে এসব আইসিউগুলো পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার-নার্স-সহযোগীদের বেছে নিয়ে, এই আপত্কালীন সময়ের জন্য তাদের সবার বেতন বাড়িয়ে এবং গ্রুপ বিমার আওতায় আনা গেলে, আমার বিশ্বাস, তারা এ কাজে অংশ নিতে রাজি হবেন। ১৫ দিনের একটি ‘ক্রাশ প্রোগ্রামের’ মাধ্যমে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলা সম্ভব।
৪) আমাদেরকে সঠিক মানের মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। ২-৩ দিন আগে বিদেশি একটি খবরে দেখলাম, ইতালির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘এস্পেসিফিকেশন’ (SPECIFICATION ) সঠিক না থাকার জন্য, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ৬০ লাখ মাস্কের একটি চালান ব্যবহার অযোগ্য ঘোষণা করেছেন ! আমি জানি না আমাদের দেশে ব্যবহারকৃত মাস্কগুলো N৯৫ মানের কি না। তবে এ ধরনের মাস্কগুলো খুবই ব্যয়বহুল। সেক্ষেত্রে সরকার চাইলে পর্যাপ্ত সংখ্যক ‘সার্জিক্যাল মাস্ক’ আমদানি করার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। বর্তমানে ব্যবহারকৃত মাস্কগুলোর বেশির ভাগই সম্ভবত মানসম্পন্ন নয়।
৫) আমাদের মতো জনবহুল একটি দেশে সকল নাগরিকের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানো একটি কঠিন কাজ। তার পরও যেসব মানুষ তাদের কোভিড-১৯ হয়েছে এমন ধারণা থেকে ‘আইডিসিআর’ (IEDCR) প্রদত্ত টেলিফোন নম্বরে ফোন করেন, তাদের সকলকে পরীক্ষা করানোর সুযোগ করে দেওয়া উচিত হবে । এসব সন্দেহজনক মানুষের ভেতরে যদি গুরুতরভাবে আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়, তাদেরকে সত্তর এ্যাম্বুলেন্সে করে আইসিইউ সমৃদ্ধ বিশেষায়িত স্থায়ী/অস্থায়ী হাসপাতালে এনে চিকিত্সা করানোর ব্যবস্থা করাতে হবে।
৬) দুই দিন আগে বেশকয়জন তরুণ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার মিলে একটি ভেন্টিলেটর যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন এমন একটি খবর কাগজে পড়েছি। বিষয়টি আশা জাগানিয়া। ঘটনাটি সত্য হলে আমাদের প্রশাসনের উচিত হবে অতি সত্তর বিষয়টি যাচাই করে দেখা এবং যন্ত্রটি ব্যবহারযোগ্য হলে সেটিকে ব্যবহারে নিয়ে আসা, প্রয়োজনে, তাদেরকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করা। ভবিষ্যতে এ ধরনের অনেক দেশপ্রেমিক নাগরিক, ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাও হয়তো এসব কাজে এগিয়ে আসবেন। সেক্ষেত্রে, সরকারের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, এ ধরনের বিষয়গুলো জানার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশাসন যেন তাদের কাছে পৌঁছে গিয়ে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
পরিশেষে, লন্ডনের ‘রয়েল লন্ডন হাসপাতালের’ এক জন বাঙালি ডাক্তারের কিছু কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করব।
‘COVID 19’ মহামারির এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন তিনি যেন এই মুহূর্ত থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নিজের হাতে তুলে নেন। বিলেতের এনএইচএস NHS এ কাজ করার সুবাদে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি এই রোগের ভয়াবহতা দেখেছি। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও এদেশে পরিস্থিতি যে কতখানি মারাত্মক তা বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। আমি এই ভেবে শিউরে উঠছি যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভয়ংকর এই পরিস্থিতিকে কীভাবে মোকাবিলা করবে। আপাতত ‘মেইক শিফট ব্যবস্থার’ মাধ্যমেও যদি অন্তত আরো ২-১ হাজার আইসিইউর ব্যবস্থা করা যায় তাহলেও অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।
এই যুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধাদের (চিকিত্সক, নার্স- সহযোগী) অনেককেই করুন পরিণতি বহন করতে হবে। সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের বাহবা দিন, তাদের উদ্দীপ্ত করুন। বিশ্বাস করুন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা তাদের সর্বস্ব দিয়ে আপনাদের বাঁচানোর চেষ্টা করবে।’
লেখক :মাস্টার মেরিনার (আয়ারল্যান্ড) এএফএনআই (লন্ডন) ও শিপিং কনসালটেন্ট
ইত্তেফাক/জেডএইচ