ক্যাটাগরি

জার্মানির চিঠি: সূর্যকে উপেক্ষা করে চার দেয়ালের ভেতর

জার্মানির সংক্রমনের তালিকা গানিতিক হারে বেড়েই যাচ্ছে এবং ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বড় বড় দেশগুলোও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সবাই জরুরি খাদ্য সংগ্রহ করে হোম কোয়ারান্টাইনে আছে। বার্লিন,  যে শহর কখনো ঘুমায় না, যেখানে লাখ লাখ মানুষের চলাচল সেখানে সব রাস্তা সব বাহন প্রায় শূন্য।

আমার শহরে বাওহাউজ স্কুল যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার পর্যটকদের ভিড় জমতো সেসব খালি পরে রয়েছে। আমিও নিজেকে এক রুমে আবদ্ধ করেছি প্রায় ২৫ দিন আগে। টিকে থাকার জন্য যা লাগে তাই নিয়ে ঘরে বসে আছি। এখানেও মানুষ হুমড়ি খেয়ে চাল, ডাল, রুটি, সবজি, ডিম, টিস্যু ইত্যাদি সাবার করে দিয়েছিল শুরুর দিকে। এখন অনেকটা শিথিল।

স্বপ্নের ইউরোপকে এভাবে দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। হোম কোয়ারান্টাইনে যেভাবে পারছি নিজেকে ব্যস্ত রাখছি, বই পড়ছি, ছবি আঁকছি, এই সমসাময়িক অবস্থার উপর টুকটাক কার্টুন করছি। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আম্মু, ভাই-বোন, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে মনে হয় এমন বাজে সময়ে অন্তত পরিবারের কাছে থাকলে ভীতিটা ভাগাভাগি করে নেওয়া যেতো। এখানে প্রতিদিন অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ এখন আর কানে বাজে না। বারান্দা থেকে হঠাৎ দু-একটা মানুষ দেখা যায়, ছোট বাচ্চারা ব্যাক ইয়ার্ডে খেলা করে। তাও একসঙ্গে নয়। আলাদা আলাদা।

ভীতিকর নির্জনতা চারদিকে। তারপরও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। সংক্রমণের তুলনায় জার্মানির মৃত্যুর হার কিছুটা কম, এর কয়েকটা কারণের মধ্যে একটি হলো সচেতনতা। এদেশের মানুষ প্রচণ্ড সতর্ক এবং সচেতন। আমি যতটা পারছি আত্মীয়-স্বজনদের সতর্ক করছি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কোথায় যেন একটা নির্বিকার ব্যাপার উপলব্ধি করি। এখনো বিয়ের প্রোগ্রাম চলছে, মসজিদে নামাজ হচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় ছেলেদের আড্ডা চলছে।

আমি এ পরিস্থিতিতে আছি বলে বুঝতে পারছি, বাংলাদেশের অবস্থা এতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আপনাদের চিন্তারও বাইরে। এভাবে চলতে থাকলে ঘরে ঘরে ছেয়ে যাবে ভাইরাস। প্রচণ্ড হতাশ লাগে এমন অবস্থা বসে বসে দেখতে। আমি দেশে থাকলে আমারও একি অবস্থা হত! আমিও নির্বিকার থাকতাম, ট্যুরে যেতাম, বন্ধুদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে চেক-ইন দিয়ে স্ট্যাটাস দিতাম ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে’, সদ্য বিদেশফেরত আত্মীয়র বাসায় যেতাম দেখা করতে, ট্রল মিম শেয়ার দিতে দিতে নিজের ফেইসবুকে পরিপূর্ণ  করতাম, বারবার মানা করলেও জনবহুল জায়গায় যোগ দিতাম, আবার সেলফিও দিতাম।

কাজের কাজ একটাই হতো, ভাইরাসটিকে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে পৌঁছাতে পাঠাও কিংবা উবারের ভূমিকা পালন করতাম। আর হাসির ইমো দিয়ে বলতাম আমাদের টেনশন নাই, বুড়োরা মরবে। বিদেশফেরত ভাইকে যখন বলা হবে, ২০ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে, তার ইংরেজিতে গালগাল দেওয়া ভিডিও শেয়ার করে বলব, আহারে দেখুন বিবেকহীন সরকার কি করছে! আবার দিন শেষে ভাইরাস ধরা পরলে সরকারের দোষ বলে চালিয়ে দেওয়া যেতো, সরকারের কাছে মাত্র এতো হাজার কিট আছে! পিপিই নাই! কতই না যুক্তিবাদী কথা।

এখন আসল কথা হল, আমার জায়গায় আপনারা হাঁটছেন ঠিক একইভাবে। যেখানে বলা হচ্ছে নিজেকেই সেইফ থাকতে, সেখানে আমি-আপনারা ব্যস্ত অন্যের দোষ খুঁজতে। আমরা ভাবতেই পারছি না সামনে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কী হতে যাচ্ছে, এক মাস পরের চিত্রটি আমাদের এখন ঝাপসা, অজানা। বাংলাদেশের মানুষের কী হাল হতে যাচ্ছে আমরা কেউই জানি না। যেভাবে ধারণা করেনি ইতালি, স্পেন ও জার্মানি। আমি ভয় পাচ্ছি, আসলেই ভয় পাচ্ছি। আমাকে নিয়ে না, এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে নিয়ে।

লেখক পরিচিতি: জুলিয়া ইউসুফ বর্তমানে পড়াশোনা করছেন জার্মানির ‘অ্যানহাল্ট ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সাইন্সে’ ইন্টিগ্রেটেড ডিজাইন বিষয়ে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ‘অরিয়েন্টাল আর্ট’ বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!