ক্যাটাগরি

সংবাদ ভাষ্য: দিদির জাদুতে কমলো মৃতের সংখ্যা

এ যেন সেই
সুকুমার রায়ের হযবরল-র গল্প। ছিল রুমাল হয়ে গেলো বেড়াল। ছিলো সাত, হয়ে গেল তিন। পি
সি সরকারের জাদুও বলা যেতে পারে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সাত হয়ে গেল তিন। এই জাদুটাই
পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে করোনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে।

বৃহস্পতিবার
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের করোনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি জানিয়ে দেয়, রাজ্যে
করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা সাত। তিনজন আগে মারা গিয়েছিলেন। গত চব্বিশ ঘণ্টায় মারা গিয়েছেন
চারজন। সাংবাদিক সম্মেলনে করোনা বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও চিকিৎসক ধীমান গঙ্গোপাধ্যায়
বুলেটিন পড়েন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কমিটির অন্য সদস্য চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী এবং স্বাস্থ্য
দফতরের বিশেষ সচিব তমাল ঘোষ। সব দিক বিবেচনা করে, সমস্ত তথ্য হাতে নিয়েই এই বিশেষজ্ঞরা
করোনার মতো জরুরি বিষয়ের বুলেটিন পেশ করেছেন। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যের উপরে
দাঁড়িয়েই তাঁরা এই রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

কিন্তু ম্যাজিক
শুরু হয় তারপরেই। দেড় ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা জানিয়ে দেন, করোনায়
মৃত্যুর সংখ্যা তিনই আছে। তা হলে আগে যে চারজনের মৃত্যুর কথা বলা হল, তাঁরা ভ্যানিশ
হয়ে গেলেন কী করে? মুখ্যসচিবের যুক্তি, ”তারা যে করোনায় মারা গিয়েছেন, তা প্রমাণ
হয়নি। তাঁদের অন্য অসুখ ছিল, তাতে মারা গিয়েছেন।”  কী করে সেটা বোঝা গেল? পুরো বিষয়টা জলের মতো পরিষ্কার
করে দিয়ে মুখ্যসচিবের ব্যাখ্যা, ”হাসপাতালে চিকিৎসার সময় চারজনের করোনার লক্ষণ দেখা
দেয়। তাদের অন্য জটিলতা ছিল। দু’জনের তো মৃত্যুর পরে ধরা পড়েছে করোনা! ফলে সে গুলি
করোনা সম্পর্কিত মৃত্যু বলা উচিত হবে না। তাতে আতঙ্ক তৈরি হবে।”

এই বিচিত্র
যুক্তিটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। আতঙ্ক ছড়াতে পারে বলে করোনায় মৃত্যু হয়েছে বলা যাবে
না? তা হলে তো প্রথম তিনটি মৃত্যুর কথাও না বললে চলতো! আতঙ্ক আরও কম হতো। মারা যাওয়ার
পর পরীক্ষার রিপোর্ট এল, তাতে দেখা গেল রোগীর শরীরে করোনা ভাইরাস ছিল। তারপরেও বলা
যাবে না, করোনায় মৃত্যু হয়েছে? এ হেন অদ্ভূত যুক্তিও মেনে নিতে হবে? যারা চিকিৎসা
করেছেন, তারা নিশ্চয়ই বলেছেন মৃত্যুর কারণ করোনা। না হলে স্বাস্থ্য দফতরের তরফে বুলেটিনে
সাতজনের মৃত্যুর উল্লেখ করা হত না। তা হলে আমরা কার যুক্তি বা রায় শুনব? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের,
না কি রাজ্যের আমলার, যিনি করোনার আতঙ্ক যাতে না ছড়ায়, তার জন্যই চিন্তিত? সব মৃত্যুই
শেষ পর্যন্ত হৃদযন্ত্র বিকল হলে হয়। তাই করোনায় মৃত্যু হচ্ছে বলার দরকারই বা কী!

আর এই ঘটনা
তো নতুন নয়। নিন্দুকেরা বলে, ডেঙ্গুতে যখন পশ্চিমবঙ্গে রোগীরা মারা যাচ্ছেন, তখন তাঁদের
ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হতো, ‘মাল্টি অর্গান ফেলিওর’ বা একাধিক দেহযন্ত্র বিকল হওয়ায়
মৃত্যু হয়েছে। এতে ভুল ধরার উপায় নেই। যে কোনও মৃত্যুরই শেষ পরিণাম তাই। কিন্তু এক
বা একাধিক দেহযন্ত্র কী কারণে বিকল হল, সে কথা লিখতে দেওয়া হয়নি সরকারি চিকিৎসকদের।
বিরোধীরা সে সময় বারবার বলেছেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা কম করে দেখাতেই মুখ্যমন্ত্রীর
নির্দেশে ‘মাল্টি অর্গান ফেলিওর’ লেখা হচ্ছে। তার আগে ম্যালেরিয়া নিয়েও একই অভিযোগ
করেছিলেন বিরোধীরা।

তা হলে কি
অ্যামেরিকা, যুক্তরাজ্য, ইটালি, ফ্রান্স, স্পেনের মতো দেশের সরকার একেবারে বোকা? তারা
তো জানিয়ে দিচ্ছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে শয়ে শয়ে লোক প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন। সেখানে
কি আতঙ্ক ছড়ানোর ভয় নেই? না কি, প্রকৃত ছবিটা প্রশাসনের কর্তারা ঢেকে রাখতে চান না,
বা পারেন না। আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বেব্র দেশগুলিতে প্রকৃত তথ্য হয় জানানো হয় না অথবা
কার্পেটের তলায় চালান করে দেওয়া হয়। করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাটা সাত থেকে তিনে নামানো
কি সেরকমই একটা প্রয়াস? বেশ কয়েক বছর আগে উত্তর প্রদেশের ক্ষেত্রে শোনা গিয়েছিল, সে
সময়ের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, অপরাধের সংখ্যা বেশি করে দেখানো যাবে না। তারপর সেখানে
এফআইআর করাই ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার।

একেই স্ট্যাটিসটিক্স
সম্পর্কে চালু কথা হল, ‘লাই, ড্যাম লাই অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স’, মানে মিথ্যা, আরও
বেশি মিথ্যার পর যা আসে তা হল সংখ্যাতত্ত্ব। অর্থাৎ, সংখ্যাতত্ত্বে হামেশাই ভেজাল থাকে।
দেশের জিডিপি-কে কম দেখানো চলবে না, তাই পদ্ধতিই বদলে দেওয়া হয়। ন্যাশনাল স্যাম্পেল
সার্ভে অর্গানাইজেশন বা এনএসএসওর রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় না। কারণ, সেই রিপোর্টে যদি
দেখা যায়, লোকে জিনিস কম কিনছে, তার মানে তো অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
এ সব বাইরে এলে লোকে আতঙ্কিত হয়ে যাবেন। বিশ্বে ভাবমূর্তি খারাপ হয়ে যাবে। তাই রিপোর্টের
প্রকাশই বন্ধ রাখো।

মুখ্যসচিব
জানিয়েছেন, ৫৩ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। ”তিন জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। নয় জন, যাঁদের
আগে রিপোর্ট পজিটিভ এসেছিল, তাঁদের রিপোর্ট এ বার নেগেটিভ এসেছে। ফলে বারোজন বাদ চলে
গেলেন। থাকলো ৪১। তিনজন করোনায় ও চারজন অন্য কারণে মারা গিয়েছেন। ফলে আক্রান্ত এখন
৩৪।” প্রশ্ন হল, যে নয় জনের প্রথম রিপোর্ট পজিটিভ এসেছিল, পরের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে,
তাঁদের তো করোনার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হল, এ বার তাঁদের কী করা হবে? তাঁদের কী ছেড়ে
দেওয়া হবে?  না কি তাঁদের আবার করোনা পরীক্ষা
করে দেখা হবে, কী রিপোর্ট আসে? না কি আপাতত তাঁদের কোয়ারেন্টিন করে রাখা হবে? জানা
যাচ্ছে না। অথচ, জানাটা জরুরি।

রাজ্যের প্রকৃত
করোনা চিত্র জানাটাও খুব জরুরি। অতঙ্ক হয় হোক। আতঙ্কিত হলে বরং লোকে লকডাউন পুরোপুরি
মেনে চলবেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবেন। যেমন, দিল্লির অধিকাংশ এলাকায় রাখছেন।  না হলে একবার গোষ্ঠী সংক্রমণ হলে তখন সামাল দেওয়ার
মতো পরিকাঠামো নেই, এই কথাটা মাথায় রাখা দরকার। তখন সাত-পাঁচ থুড়ি সাত-তিনের জাদু
চলবে না।