কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিস) ইউনিটের একটি দল মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে দণ্ডিত এই আসামিকে গ্রেপ্তার করে। পরে দুপুরে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
দেশে নভেল করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে আদালতপাড়া এখন ফাঁকা। খুব জরুরি মামলা ছাড়া আদালতও বসছে না।
মাজেদকে যখন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তোলা হল, তখন আদালত প্রাঙ্গণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সংবাদকর্মী ছাড়া মানুষ ছিল সামান্যই।
ঢাকা কোতোয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, “অন্য সময় হলে ভিড় সামাল দিতে অনেক কষ্ট হত। আজ সেই ঝামেলা হয়নি। তারপরও কিছু উৎসুক মানুষ এসেছিল বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুল মাজেদকে দেখতে।”
আবদুল মাজেদের বাবার নাম আলী মিয়া চৌধুরী, মায়ের নাম মেহেরজান বেগম, বাড়ি ভোলার বোরহান উদ্দিনের কালীগঞ্জের বাটমারায়।
মাজেদের স্ত্রী সালেহা বেগম, চার মেয়ে ও এক ছেলে ঢাকা সেনানিবাসের এক নম্বর রোডের একটি বাসায় বসবাস করছেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে পলাতক আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন মাজেদ। তখন তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, “মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশগ্রহণ করেনি, সে জেলহত্যায় অংশগ্রহণ করেছেন বলে আমাদের জানা রয়েছে। খুনের পরে জিয়াউর রহমানের নির্দেশ মোতাবেক সে বঙ্গভবন ও অন্যান্য জায়গায় কাজ করেছে।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মাজেদ কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বে ছিলেন। অন্য খুনিদের সঙ্গে দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত বঙ্গভবনে ‘বিভিন্ন দায়িত্ব’ ছিল তার।
পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়ায় চলে যান মাজেদ। তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের নির্দেশেই তারা সে সময় নিরাপদে দেশ ছেড়ে যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
মাজেদরা লিবিয়ায় ছিলেন তিন মাস। এরপর ‘পুরস্কার হিসেবে’ তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাজেদকে পাঠানো হয় সেনেগাল দূতাবাসে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ আবদুল মাজেদকে বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে উপসচিবের মর্যাদায় তিনি বিআইডব্লিউটিসিতে যোগ দেন।
পরে তাকে তখনকার যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ‘ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট’ শাখার পরিচালক করা হয়। এরপর দেওয়া হয় তখনকার জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের পরিচালকের দায়িত্ব।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বিচারের পথ খোলে। মামলার পর বিচারও শুরু হয়। সে সময় আটক হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে যান আবদুল মাজেদ।
এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গেলে ফের শ্লথ হয়ে যায় মামলার গতি। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে পলাতক আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার কারাগারে পাঠানো হয়।
সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া আসামিদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি) ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি।
কিন্তু খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খানের মত আবদুল মাজেদও পলাতক ছিলেন।
এতদিন কোথায় পালিয়ে ছিলেন মাজেদ?
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই দশকের বেশি সময় ভারতে আত্মগোপনে ছিলেন মাজেদ। সেখানে তিনি থাকতেন কলকাতায়। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তিনি দেশে ফেরেন।
তবে কীভাবে তিনি দেশে ফিরলেন এবং এরপর গত প্রায় তিন সপ্তাহ কোথায় ছিলেন- তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা হাস্যরসের ছলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “করোনার ভয়ে মনে হয় চলে এসেছে বাংলাদেশে।”
মঙ্গলবার মাজেদকে গ্রেপ্তার করার পর সন্ধ্যায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “এখন ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করার জন্য আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে এবং আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই রায় কার্যকর করা হবে।”
আইনজীবীরা বলছেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সময় বহু বছর আগেই পেরিয়ে যাওয়ায় সেই সুযোগ আর মাজেদ পাবেন না। তবে সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ তার থাকবে।
সেই আবেদন তিনি না করলে বা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে সরকার এই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারবে।