দেশব্যাপি সেনা বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম।
সারা বিশ্বের মতই করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় স্থবির বাংলাদেশ। করোনা মোকাবেলাকে যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই যুদ্ধে সামনে থেকে লড়াইয়ের ঘোষণা দেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। স্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেন, ‘আমরা সৈনিক, আমরা সব সময় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং সেই প্রস্তুতি নিয়ে আমরা আছি। সবাইকে সহযোগিতা করবো।’ তাঁর এই প্রবল আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ প্রমাণ করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করেই দেশের মানুষকে সুরক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
২৫ মার্চ থেকে মাঠ পর্যায়ে এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। সচেতনতা তৈরি, চিকিৎসা সেবা প্রদান ও লক ডাউন কার্যকর করার পাশাপাশি দুস্থ ও অসহায়দের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় উপকরণও সরবরাহ করছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী।
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, সাভার, লালমনিরহাটসহ দেশের প্রতিটি এলাকাতেই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে সেনা সদস্যরা। দেশপ্রেম আর মানবিক বোধ থেকেই মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নিজেরা বিনামূল্যে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন। সেই সঙ্গে রোদ, বৃষ্টি ও ঝড় উপেক্ষা করে সড়কে সড়কে টহল দিয়ে সাধারণ মানুষকে যেমন সতর্ক করছে, তেমনি ‘সঙ্গনিরোধ’ নিশ্চিতেও তেড়েফুঁড়ে না ছুটে ইতিবাচক পদক্ষেপে জয় করেছে দেশের মানুষের হৃদয়। করোনাভাইরাস বিশ্বে মৃত্যুর মিছিলে নিত্যদিন হাজার হাজার নাম যোগ করায় দেশের ৬২ টি জেলায় ৫৪৬ টি দলে বিভক্ত হয়ে প্রায় ৭৫০০ জনেরও বেশি সেনা সদস্য নানা কায়দায় ঘর থেকে বের হওয়া মানুষকে সচেতন করছে।
ফুল হাতে দিয়ে প্রত্যেককে ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানানো এবং দুস্থ ও হত দরিদ্ররা কাজের খোঁজে বের হলে তাদের প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা প্রদান করে নিজ নিজ ঘরে ফেরত পাঠানোসহ জন সচেতনতায় গৃহীত সেনাবাহিনীর পদক্ষেপগুলো সকল স্তরের মানুষের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ ছাড়াও হাতে হাতে শোভা সচেতনতামূলক প্ল্যাকার্ড নিয়ে তীব্র কণ্ঠে তা উচ্চারণ করে অদৃশ্য ভয়ংকর শত্রু এই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে নিজেদের সমর্পণ করেছেন তাঁরা। ‘আতঙ্ক না ছড়াই, সতর্ক থাকি, সাহায্য করি’ কিংবা ‘ঘন ঘন হাত ধুই করোনা থেকে নিরাপদ রই।’ তাদের টহল গাড়িতেও দেখা মিলছে ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করুন’ লেখা স্টিকার।
সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের মাধ্যমে করোনার ভয়াল থাবা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে এসব সেনা সদস্যরা নিয়মিত টহল জোরদার করে সড়কে বা অলিগলিতে সাধারণ মানুষের জটলা ভেঙে দিচ্ছেন। ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজনকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনছেন। গাড়ি থামিয়ে কথা বলছেন তাদের সঙ্গে। নির্ধারিত পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে সড়কে বের হওয়া গাড়ির চারপাশে তাদের জীবাণুনাশক ছিটানোর দৃশ্যও চোখে পড়েছে হরহামেশাই। মরণঘাতী এই ভাইরাসের মধ্যেও নিজেরা পেশাগত দায়িত্ব পালনে অনড় অবস্থানে রয়েছেন। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করতে ব্যবহার করছেন সাধারণ নিরাপত্তা সামগ্রী। দূরত্ব মেনে চলাচল ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাতেও নিজেরা জোর দিয়েছেন।
দেশব্যাপী সেনাবাহিনীর চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামাজিক কার্যক্রম ‘সিমিক’র সুনাম রয়েছে। এবার নিজ দেশে একইভাবে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এতে করে চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত প্রতিটি মানুষের আস্থা আর ভালোবাসার অপর নাম হয়ে উঠেছেন সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা। সবাই একবাক্যে সেনা চিকিৎসকদের আন্তরিকতায় নিজেদের সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বিগত দিনগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসকের অপ্রতুলতা, অনেক ডাক্তার ও নার্সের অনুপস্থিতি এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে নুন্যতম সেবাও পাচ্ছে না সাধারণ রোগীরা। করোনার উপসর্গের সঙ্গে নুন্যতম মিল না থাকলেও রোগী ভর্তি অথবা চিকিৎসাসেবা দিতে চরম অনীহা প্রকাশ করছেন চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে বেশ কিছু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। চিকিৎসকরাও নিজেদের চেম্বার বন্ধ করে বাসায় অবস্থান করছেন। হাসপাতালের মূল ফটকেও ঝুলছে তালা। ভেতর থেকেও সাইনবোর্ডে জায়গা করে নিয়েছে ‘ক্লোজ’ শব্দটি। ভয়ঙ্কর এ চিত্র রাজধানীর বাইরের সরকারির হাসপাতালসমূহেও। খুলনায় চারটি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে রিফাত নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যুর খবরটি এখন ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’।
জ্বর, সর্দি-কাশির রোগীর বাইরে হৃদরোগ কিংবা কিডনি রোগে ভুগলেও মিলে না চিকিৎসা। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে করতেই বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অবশ্য এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্রাইভেট চেম্বারগুলোর বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। কিন্তু তারপরও পরিপূর্ণ সুরাহা হচ্ছে না সমস্যাগুলো। আর এখানেই ভিন্ন নজির স্থাপনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সব সময় বলে আসছেন, ‘দুর্যোগ মোকাবেলাসহ সব কাজে সুনাম অর্জন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। শুধু সামরিক অফিসার হিসেবে নয়, মানবিক গুণাবলীর কারণে বাংলাদেশের সেনারা মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে।’
বাঙালি জাতির এমন সংকটময় মুহূর্তেও নিজেদের জীবনের কথা না ভেবে, নিজেদের পরিবার-স্বজনদের মায়া পেছনে ফেলে অন্ধকারে আশার আলো জ্বালিয়েছেন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি জেলায় অসহায় বিপন্ন মানুষের পাশে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রতিদিনই দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায় জ্বর, ডায়াবেটিস, পেটের পীড়া ও পুষ্টি হীনতায় ভোগা রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দিচ্ছেন সেনা চিকিৎসকরা।
৩৫ ফিল্ড অধিনায়ক কর্নেল মো. নাজমুল হুদা খান জানান, কুমিল্লা জেলাসহ বৃহত্তর কুমিল্লার ৬টি জেলায় সেনাবাহিনীর ৮টি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দৌড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করছে। যারা অতি প্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছেন তারাই এ সেবা পাচ্ছেন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে আমরা যাচ্ছি যেখানে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দিনমজুর, পথশিশু, অসহায়রা আছেন তাদের সেবা দিচ্ছি।
রংপুর ৩৪ ইস্ট বেঙ্গল সেনাবাহিনীর (সিএমএইচ) চিকিৎসক ডা. মেজর কাওসার জানান, চরাঞ্চলের অসহায় গরীব মানুষরা যাতে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়, এ লক্ষ্যেই প্রত্যেকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বিনামূল্যে ওষুধসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে।
“কোনো মা-ই তার সন্তানকে ‘উৎসর্গ’ করতে চান না। কিন্তু আমাদের মা আমাদেরকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছেন। দেশপ্রেমের যে শপথ নিয়ে সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম জীবনের বাকীটা সময়েও একই পথে নিজেকে অবিচল রাখতে চাই। এটাই আমাদের সৈনিকদের মূলমন্ত্র।”- কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরে টহলরত এক সেনা সদস্য। এ কথা শুধু তার একার নয়, বরং সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যের অন্তরে থাকা দেশপ্রেমের কথাই যেন প্রতিধ্বনিত হয় এই সেনা সদস্যের কণ্ঠে।
ইত্তেফাক/আরএ