লকডাউনের প্রভাব
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এখন গৃহবন্দি থাকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে নিজেকে আক্রান্ত হওয়া থেকে যেমন ঠেকানো সম্ভব, তেমনি অপরকেও ঝুঁকিমুক্ত রাখার এটাই সবচেয়ে ভালো পন্থা। অথচ মানুষ একা থাকতে পারে না। আমাদের সব সময় মানুষের সঙ্গেই প্রতিদিন কাটাতে হয়। প্রতিদিনের জীবন চলে নির্দিষ্ট ছকে। লকডাউনের জন্য সেই নির্দিষ্ট ছকটাই গেছে ওলট-পালট হয়ে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে মেলামেশাটাই গেছে বন্ধ হয়ে। ফলে ঘরে পরিবারের সঙ্গে থেকেও আমরা কখনো কখনো একা বোধ করছি। গ্রাস করছে বিষণ্ণতা। এই ঘরবন্দি অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন আত্মীয়স্বজন একে অপরের সঙ্গে হঠাত্ করেই রূঢ় আচরণ করে ফেলছি।
অল্প বয়সিদের জীবনকে এই লকডাউন অবস্থা একঘেয়ে করে তুলেছে। যদিও তারা ভিডিও গেম, কার্টুন, মুভি নিয়ে বেশ সময় কাটাচ্ছে। বিশেষ করে যারা শহরে থাকেন, তাদের জন্য খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কারণ শহরে খেলাধুলার সুযোগ তো এমনিতেই নেই। শিশু-তরুণেরা বাসায় সময় কাটিয়ে অভ্যস্ত। ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় মানসিক অবসাদে ভুগছে তারা।
তবে লকডাউনের সময় ইতিমধ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক্লাস চালু হয়ে গিয়েছে। ফলে পাঁচ বছর থেকে ১৩-১৪ বছর বয়সিদের বাড়িতে পড়াশোনা করে সময় কাটাতে বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। এছাড়া মা-বাবার সঙ্গে ঘরের কাজেও বেশ সময় দিচ্ছে তারা, যেটা একটা পিকনিক মুড এনে দিয়েছে তাদের জন্য।
খুব বড়ো রকমের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, যারা অফিস ও ব্যবসা নিয়ে দিনের একটা বড়ো সময় বাইরে কাটান। আর প্রবীণ ব্যক্তি যারা বাসায় থাকলেও প্রতিদিন হাঁটতে যান, বাজার করেন কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ার ভেতরে বসে আড্ডা দেন, তাদের সমস্যা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। লকডাউনের কারণে তাদের সেই অভ্যাস হঠাত্ বদলে যাওয়ায় তারা বিষণ্নতায় ভুগছেন।
ধানমন্ডির বাসিন্দা শারমিন রহমান বললেন, অফিস নেই। ঘরে থেকে সব সময় একটা মানসিক চাপের মধ্যে আছি। প্রতিদিন এত এত মৃত্যুর খবর। সংক্রমণের ভয় গ্রাস করছে। এছাড়া কবে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাব, চাকরির দুশ্চিন্তা—সব মিলিয়ে নানা ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে।
উত্তরার বাসিন্দা শামীমা আক্তার বললেন, ঘরে থাকলেও দুশ্চিন্তা কিন্তু কাটছে না। বাজার ফুরিয়ে গেলে তখন কীভাবে খাবার কিনব? চাল পাওয়া যাবে তো দোকানে? না পেলে বাচ্চাদের কী খাওয়াব? এই সব আতঙ্ক এসে ঘিরে ধরে। সবচেয়ে ভয় লাগে বাসার বয়স্ক মা-বাবা যদি হঠাত্ অসুস্থ হয়ে যান তখন কী হবে! এসব চিন্তায় যেন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি।
কল্যাণপুরে ছেলের বাসায় থাকেন লিয়াকত আলী। তিনি বললেন, ‘আমার কোনো কাজ নেই। অন্য সময় প্রতিদিন সকালে হাঁটতে যেতাম। দুপুরে নাতিকে স্কুল থেকে আনতাম। সন্ধ্যায় পাড়ার মসজিদে নামাজ পড়ে অনেকের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। এখন সব বন্ধ। খুব খারাপ লাগে। ঘুমানো, খাওয়া আর টিভি দেখা ছাড়া কোনো কাজ নেই।
এ প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল বলেন, বাড়ি থাকলেও প্রবীণদের সেই সামাজিক যোগাযোগটা বজায় রেখে চলতে হবে। আর তা করতে হবে টেলিফোনে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে। আর টেলিভিশনের খবরটার ওপর নিয়মিত নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে সরকারি ঘোষণা বা বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে, যাতে বাইরের জগতের সঙ্গে তারা আপডেটেড থাকতে পারেন। তবে টেলিভিশনে মৃত্যু বা দুঃখ, শোকের খবর থেকে নিজেদের যদি তারা দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন, তাহলে সেটাই সবচেয়ে ভালো। তার বদলে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, মন ভালো করা টিভি সিরিয়াল বা পুরোনো দিনের সিনেমা দেখতে পারেন। শুনতে পারেন পুরোনো দিনের আনন্দের গান। বাড়িতে নিয়মিত ব্যায়াম করতেও পারেন। এছাড়া নাতিনাতনি, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ইনডোর গেম খেলে সময় কাটান। কোনোভাবেই একা একা তাদের থাকতে দেওয়া যাবে না।