সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে পারে আপনাকে এবং অন্যকে
রাজধানী ঢাকার তিন আবাসিক এলাকাসহ সারা দেশে মোট পাঁচটি ক্লাস্টার (একটি এলাকায় কম দূরত্বের মধ্যে অনেক রোগী) থেকে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন করোনা ভাইরাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই সামাজিক দূরত্ব মেনে সরকার নির্দেশিত পথে না চললে পরবর্তীতে কারোর পক্ষেই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
সারা দেশের ২১ জেলায় এই ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে। রাজধানীর মিরপুর এবং বাসাবো এলাকা দুটি দেশের সবচাইতে বড় দুটি ক্লাস্টার। এ ছাড়াও নতুন ক্লাস্টার হিসেবে যুক্ত হচ্ছে উত্তরা। মোট ৩৩০ জন করোনায় আক্রান্ত রোগীর মধ্যে রাজধানীর ১৮৫ জনের অধিকাংশ এই এলাকার অধিবাসী। ঢাকার পরে সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে নারায়ণগঞ্জে, ৪৬ জন। অন্য জেলাগুলোর মধ্যে মাদারীপুরে সবচেয়ে বেশি ১১ জনের শরীরে এই ভাইরাস ধরা পড়েছে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত মুখ্য চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকান। ইতালি, স্পেন, ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্র; তাদের এত উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার পরও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর কী করতে পেরেছে তারা? যদি আমাদের দেশেও মহামারী আকারে এই রোগ ছড়ায়, তাহলে চিকিৎসকদের বা সরকারের করার কিছুই থাকবে না। আমরা ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়ে যাবো। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং সরকার নির্দেশিত পথে চলা এই দেশের সকলের দায়িত্ব। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমরা অধিকাংশরাই তা মানছি না। এভাবে চলতে থাকলে যখন মহামারী শুরু হবে তখন আমরা চিকিৎসকেরা কতজনকে চিকিৎসা দেবো, সরকারই বা কতজনকে সহায়তা করতে পারবে!
ঢাকায় ক্লাস্টার জোন মিরপুর টোলারবাগ, বাসাবো এবং উত্তরা। অন্যদিকে জেলা হিসেবে সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ ক্লাস্টার নারায়ণগঞ্জ। গতদিন আইইডিসিআর-এর সংবাদ সম্মেলনেও বলা হয় তৃতীয় স্তরে ক্লাস্টার ভিত্তিক সংক্রামণে নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস। অথচ এই এলাকার অনেকেই এখনো মানছেন না লকডাউন। সুযোগ পেলেই অকারণে বাসার বাহিরে আসছেন। এ বিষয়ে বেশ কিছু ভিডিও দেখে বোঝা যাচ্ছে, শুধু নিয়ম ভঙ্গের জন্যই বাড়ির বাহিরে আসছেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেকের ঘরে ঘরে পুলিশ পাঠিয়ে লকডাউন কার্যকর করা সম্ভব নয়। যদি প্রত্যেকে নিজ থেকে না মানে তাহলে প্রশাসন দিয়ে লকডাউন কিভাবে হবে?
এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চীনের উদাহরণ টেনে বলেন, চীনের পরিস্থিতি ছিলো সবচাইতে ভয়াবহ। ভাইরাসটি সম্পর্কে বুঝে ওঠার আগেই তা ক্লাস্টার আকারে ছড়িয়ে পরে এই দেশে। কিন্তু সেখানে সরকারের নির্দেশ মেনে সকল নাগরিক লকডাউন কার্যকর করে। এখন দেখুন তাদের অবস্থা। আমাদের এখনো দেরি হয়ে যায়নি। স্বল্প আকারে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এখন যদি লকডাউন কার্যকর করা না যায়, তাহলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাবে। আর সেই জন্য আমরা প্রত্যেকে দায়ী থাকব।
এ প্রসঙ্গে সাবধানতা উচ্চারণ করে বুধবার মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, নভেল করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের যে স্তরবিন্যাস রয়েছে, তার তৃতীয় ধাপে পৌঁছেছে বাংলাদেশ- এখন সবাই সাবধান না হলে চতুর্থ ধাপ অর্থাৎ মহামারীর মুখোমুখি হতে হবে। তিনি এ সময় বেশ গুরুত্ব দিয়ে বলেন, আমরা এখন সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। এটা যদি যথাযথভাবে পালন করা না হয় তবে চতুর্থ স্তরে চলে যেতে পারি।
এমন এক মূহুর্তে ঢাকায় পোশাক শ্রমিকদের ডেকে আনা চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই শ্রমিকদের ডেকে আনার পর নতুন করে ৯২ জনের দেহে শনাক্ত করা হয়েছে করোনা ভাইরাস। যা সারা দেশকে নতুন করে হুমকির মুখে ফেলেছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, বর্তমান সময়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এবং তা ঘোষণা করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত। ভাইরাসের এই সংক্রমণ রোধে সকলে যদি বিশেষজ্ঞ হতো তাহলে বিশ্বে কোন সমস্যাই থাকত না। কিন্তু যেহেতু আপনি বিশেষজ্ঞ নন, সুতরাং হঠাৎ করে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশ ও জাতিকে বিপদের মুখে ফেলার কোন অধিকার আপনার নেই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ সহমত পোষণ করে বলেন, এ সময় সকলকে খুব ধীর স্থির ভাবে সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা আমাদের সকলের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এর কোন বিকল্প নেই। এটি না মানলে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে।
কিন্তু লকডাউন পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হলে কী হবে দুস্থ ও হত দরিদ্রদের? তাদের কাছে কিভাবে খাবার পৌঁছাবে? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, রাজধানী ঢাকার ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত আমাদের কর্মী রয়েছে। সারাদেশেও ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে রয়েছে এই কর্মী বাহিনী। অবিন্যস্ত ভাবে ত্রাণ প্রদান না করে নির্দিষ্ট এই মাধ্যম ব্যবহার করে হত দরিদ্র এবং ক্ষেত্র বিশেষে নিম্ন মধ্যবিত্তের তালিকা করে তাদের কাছে খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হবে। কিন্তু ত্রাণ প্রদান বা ত্রাণ গ্রহণের জন্যও এই সময় কোন ভিড় বা লোক সমাগম করা হবে চরম ভুল।
সর্বশেষ তিনি বলেন, এখনও সময় আছে। এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর সে জন্য ১৯৭১ সালের মতই একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। আর এভাবেই আমরা করোনাকে প্রতিহত করব। এটা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। এটি সরকার বা কোন কিছু নিয়ে সমালোচনার সময় নয়। এটা একতাবদ্ধ হয়ে মোকাবেলার সময়। এই যুদ্ধাবস্থা শেষে সমালোচনার অনেক সুযোগ পাবেন। কিন্তু এখন জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ হয়ে করোনা মোকাবেলার সময়।
ইত্তেফাক/আরএ