শহরজুড়ে কঠোর লকডাউন, এক কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার প্রায় সবাইকে শনাক্তকরণ পরীক্ষার আওতায় আনাসহ কর্তৃপক্ষের নানান পদক্ষেপের ফলে গত প্রায় ৭ মাস ধরে হুবেই প্রদেশের এ রাজধানীতে স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত কোনো কোভিড-১৯ রোগী পাওয়া যায়নি।
এখন শহরটির সব রেস্তোরাঁ, দোকানপাট আর বারে উপচে পড়া ভিড়; এর মধ্যেও স্থানীয়দের মানসিক স্বাস্থ্য ও কাজে লকডাউনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
উহানের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সেসময় অজানা ভাইরাস সম্পর্কে বাসিন্দাদের প্রথম সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। তার বছরপূর্তির আগে রয়টার্স উহানের বাসিন্দাদেরকে প্রাদুর্ভাবের সময়কালে তাদের তোলা ছবি ও ভিডিও শেয়ার এবং ২০২১ সালকে নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা শুনতে চেয়েছিল।
জবাবে বেশিরভাগ বাসিন্দাকে তাদের শহরের এখনকার আলো ঝলমলে চেহারার মতোই আগামী বছর নিয়ে ব্যাপক আশাবাদী হতে দেখা গেছে।
তারই একজন আন জুনমিং; উহান যখন ৭৬ দিনের কঠোর লকডাউনে ছিল জুনমিং তখন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিজেদের বাড়িতে আটকে থাকা মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিতেন।
“সেসময় আমি কেবল এক বেলা খেতে পারতাম। কেননা, এত কাজ পড়ে ছিল আর লোক ছিল এত কম যে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তাম। আশা করছি ২০২১ সালে পুরো শহরটি আরও সমৃদ্ধ হবে,” বলেছেন তিনি।
প্রাদুর্ভাবের ভয়াবহতা ও লকডাউনের স্মৃতি এখনও দগদগে; তা সত্ত্বেও ওই সময় নিয়ে মজা করতে ছাড়েননি জুনমিং।
“বলা যেতে পারে ২০২০ সালে সমগ্র উহানের রাস্তাগুলোতে কোনো মানুষ ছিল না, বাইরে কেবল প্রাণীরাই সক্রিয় ছিল,” বলেছেন তিনি।
উহানের ব্যান্ড দল ‘ম্যাড র্যাটের’ মূল গায়ক ঝ্যাং ঝিংহাও লকডাউনের সময়টাতে গান আর সুর নিয়েই মত্ত ছিলেন।
“ওই সময় আমি ঘরে কিছুই করতে পারতাম না। সময়টা ছিল খুবই বিরক্তিকর। তখন ভাবলাম, জীবনে আনন্দের খোঁজ পেতে আমার কিছু গান লেখা ও সুর দেওয়া দরকার। জীবনে প্রথমবার এমন দুর্যোগের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।
“মহামারীকে অবজ্ঞা করলে চলবে না। বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সংক্রমণের খবর দেখেছি আমি; এই কারণেই একে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। আমাদের ভাবা উচিত নয় যে আমরা খুবই শক্তিশালী। আমার মনে হয়, সত্যিকার অর্থে আমরা মানুষরা খুবই দুর্বল,” বলেছেন তিনি।
ব্যবসায়ী দুয়ান লিংয়ের স্বামী চিকিৎসক ফেং ইউশান ফেব্রুয়ারিতেই কোভিড-১৯ এর খপ্পরে পড়েছিলেন।
“মহামারীর মধ্যে সে যেদিন হাসপাতালে ভর্তি হল, সেদিনই ছিল আমার জন্মদিন। সে পুরো একদিন ব্যয় করে একটি ভিডিও সম্পাদনা করে আমাকে পাঠিয়েছিল। আমি খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ২০২০ সালে আমাদের অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে; আমি এই বছরকে বিদায় বলতে চাই। নতুন বছরে আমাদের একটি সন্তান হবে বলেই প্রত্যাশা করছি আমি,” বলেছেন ৩৬ বছর বয়সী এ নারী।
জাপানি রেস্তোরাঁ মালিক লাই ইউয়েন অবশ্য ২০২০ সাল থেকেও অনুপ্রেরণা নিতে চান।
“ওই সময়ে উহানে সময় যেন উড়ে যাচ্ছে বলে আমাদের সবার মনে হচ্ছিল। আমার মনে হয় কোভিড-১৯ আমাদের যে ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, তা হল সুস্বাস্থ্য অন্য অনেক কিছুর থেকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ডিজাইনের শিক্ষার্থী ও মেংজিং শঙ্কায় আছেন সংক্রমণের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ নিয়ে।
“উহানের প্রাদুর্ভাব অনেকের উপরই ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। অনেক কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে, বাসিন্দারা চাকরি হারিয়েছেন। এগুলো উহানের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
“আমি উহানে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে উদ্বিগ্ন; দেশের বিভিন্ন অংশে ভাইরাসটির পুনরাবির্ভাব দেখা গেছে আর উহানে কলেক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি,” বলেছেন ২২ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী।
রাস্তায় খাবার বিক্রি করা জিয়ান হোংউয়া এ বছর নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট।
“প্রাদুর্ভাবের সময় আমাদের পুরো পরিবার একসময় ছিল। এমনটা বেশ বিরল; এবং আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার ২০২০ সাল আসলে ঠিকই গেছে বলে মনে হচ্ছে। আমি ভাগ্যবান যে আমি আমার পুরো পরিবারের জীবনযাপনের খরচ চালাতে পেরেছি। ২০২১ সালে আমার ব্যবসাও ভালো হবে বলে প্রত্যাশা করছি,” বলেছেন উহানের এই ৩৪ বছর বয়সী বাসিন্দা।
আগামী বছরে সবাই যেন নিরাপদে থাকতে পারে তাই প্রত্যাশা করছেন স্ট্রিট ড্যান্সার লিউ রুনলিয়ানের।
“২০২১ আসছে। নিজের জন্য খুব বেশি কিছু চাইছি না। চাইছি শান্তিপূর্ণভাবে যেন জীবনযাপন করতে পারি। তারপর চাই সবাই যেন নিরাপদে থাকেন,” বলেছেন তিনি।