এই ইতিবাচক পরিবর্তন রক্ষা করতে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে প্রাকৃতিক পর্যটন স্থানগুলোতে মানুষের বিচরণ বছরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে চায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন অধিদপ্তর।
কোভিড-১৯ মহামারীর ‘লকডাউনের’ সময় ‘জীববৈচিত্র্যের অবস্থার উন্নতি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লকডাউনের সময় পরিবেশের ‘ফিরে আসা’ তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশকে পুনরুদ্ধারে প্রথম পদক্ষেপই হবে মানুষের নির্বিচারে পর্যটন বন্ধ করা’।
তবে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে।
বৈশ্বিক মহামারী রূপ নেওয়া ছোঁয়াচে রোগ কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ আটকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার, যা চলে ৩১ মে পর্যন্ত।
এসময় মানুষের চলাচল বন্ধ থাকায় দেশের ১৯টি জাতীয় উদ্যান ও বনভূমির সজীব চেহারা ফিরে আসে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মহামারীর মধ্যে মানুষের চলাচল সীমিত হওয়ায় কক্সবাজার সৈকতে দেখা মেলে ডলফিন-বিরল কচ্ছপের, বুড়িগঙ্গার পানি কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে কমে আসে দুর্গন্ধ, ঢাকার আরেক নদী তুরাগে উঁকি দেয় শুশুক।
লকডাউনের মধ্যে কক্সবাজার সৈকতে দেখা গিয়েছিল গোলাপি ডলফিনের।
মহামারীকালে বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান ও বনাঞ্চলে বন্যপ্রাণীর জীবনযাত্রার পরিবর্তন ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর।
মৌলভীবাজারের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মানুষের চলাচল বন্ধ থাকায় লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বন্যপ্রাণীর বিচরণ বেড়েছে, যা আগে কম ছিল।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, লকডাউনের সময়ে পাখির কলরব আগের চেয়ে বেড়েছে দুটি উদ্যানে। উদ্যানের ভেতরের রাস্তায় যান চলাচল কম হওযায় বন্যপ্রাণীর পারাপার বেড়েছে।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক এলাকায় সাধারণ ছুটির সময় মানুষ চলাচলের সময় রাস্তায় বন মোরগ ও বন্য শুকরের চলাচল বেড়েছে। অজগর, গুইসাপের মতো সরিসৃপ প্রাণীর চলাচল দিনের বেলায় বেড়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের ‘ন্যাচারাল রিজেনারেশন’ হচ্ছে।
খাঁচায় আবদ্ধ প্রাণির আচরণও পরিবর্তন হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
বাঁশখালী ইকোপার্কের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময় পার্কে বন্য হাতির চলাচল বেড়েছে। মায়া হরিণের বিচরণ দেখা যাচ্ছে। বেড়েছে বানরের চলাচল। বন মোরগ ও মাথুরার আনোগোনা বেড়েছে।
বাঁশখালী ইকোপার্কে কুমারিয়া, পাইরাছ, আসাম ইত্যাদি লতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া মেছো বাঘ, ছোট বাগডাঁশা, বড় বাগডাঁশা, শিয়াল, বিরল গন্ধগোকুল ইত্যাদির বিচরণ বেড়েছে।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারীকালে প্রকৃতিতে দূষণ কমে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীর নিরাপদ প্রজনন ও বংশবৃদ্ধিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউনের সময় মাঠ পর্যায় থেকে আমরা যে তথ্য পেয়েছি, তাতে দেখা গেছে পর্যটন বন্ধ থাকায় বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণীদের ওপর পজিটিভ সাইন এসেছে।
“সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকায় সাময়িকভাবে মানুষের চলাচল বন্ধ করা হবে, তবে সেটা পরিবেশ ও প্রাণীজগতের জন্য ভালো হবে। তার প্রমাণ লকডাউনের সময় পেয়েছি।”
‘ফিরে আসা’ প্রকৃতিকে ধরে রাখার লক্ষ্য
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জের নির্বাহী পরিচালক আহসান উদ্দিন আহমেদ মনে করছেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নিলে তাতে লাভবান হওয়ার আশা খুব বেশি নেই।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনি যদি স্যাটেলাইট ইমেজে দেখেন, তবে গ্রামগুলোতে ৪০ বছরের আগের চেয়ে সবুজ বেশি দেখবেন। কিন্তু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সবুজ কমেছে। আইন দিয়ে কাজ হয়নি। গণসচেতনতার কারণে গ্রামে সবুজ বেড়েছে।”
মানুষ চলাচল কম থাকায় জীববৈচিত্র্য বেড়েছে বলে যে কথাটা বন বিভাগ বলছে, পদ্ধতিগত গবেষণার আগে তা মেনে নিতে চান না আহসান।
তিনি বলেন, “এটা র্যানডমলি বলেছে। বৈজ্ঞানিকভাবে এটা বলতে হবে। আর বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে অন্তত তিনটি সময়ের ডেটা দরকার। একটা বছরের একটা সময় নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। এখানে এটা তড়িঘড়ি ভাব আছে।”
“আমি বলছি না যে মানুষের সারা বছর যাওয়া উচিত। আমি বলছি একটা সার্বিক বিশ্লেষণ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক,” বলেন তিনি।
আরেকটি শঙ্কা প্রকাশ করে এই গবেষক বলেন, “এত আইনের পরেও বন বিভাগের অর্জন কম। বরং তাদের কারণে নষ্টই হয়েছে। মানুষের আনাগোনা দূরে রেখে বন বিভাগ বড় বড় গাছপালা কেটে ফেলার আয়োজন করবে? আমার সন্দেহটা থেকে যায়।”
এদিকে সুন্দরবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাত মাস পর্যটন বন্ধ ও পর্যটকবাহী জলযান চলাচল বন্ধ থাকায় বন্যপ্রাণী, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের বংশবিস্তার নিরবচ্ছিন্ন ছিল।
ওই সময় সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বাঘের উপস্থিতি বাড়ার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, গত এপ্রিল মাসে বাগেরহাট রেঞ্জের কচিখালী অভয়ারণ্য এলাকার অফিস চত্বরে বাঘের হরিণ শিকার দেখা গেছে। শরণখোলা রেঞ্জের বোলা টহল ফাঁড়িতে বাঘ দেখা গেছে। তেরাবেকা টহল ফাঁড়ির অফিস চত্বরে বাড়ের বিচরণ দেখা গেছে। কয়েকটি টহল ফাঁড়ি থেকে বাঘের গর্জন শোনা গেছে। এসব এলাকায় আগে বাঘের বিচরণের তথ্য ছিল না।
বাঘের জন্য ‘শাপে বর’ হয়ে এসেছে মহামারী
২০১৬ সালের ৯ জুলাই পূর্ব সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্য এলাকার একটি খালে দেখা মেলে এই বাঘের। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
বন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণ হ্রাস পাওয়ায় যে সব এলাকায় বন্য প্রাণী দেখা যেত না, সেসব এলাকায় বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ দেখা গেছে। এছাড়া বনের মধ্যে মাছ, কাঁকড়া, মৌমাছিসহ সকল উদ্ভিদ ও প্রাণির বংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতীয় উদ্যানগুলোতে নির্দিষ্ট সময় পর্যটন বন্ধ রাখার বিষয়ে গত জুলাই মাসে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় জীববৈচিত্র্য থেকে শুরু করে পরিবেশে একটা ইতিবাচক দিক লক্ষ্য করা গেছে। সেটা বন্যপ্রাণী, বন সব ক্ষেত্রে।
“এই ধারাটাকে আমরা ধরে রাখতে চাই। জাতীয় উদ্যানগুলো থেকে টিকেট বিক্রি বা এসব থেকে ১০ কোটি টাকা রাজস্ব পাই। এটা আয়। এবার ক্ষতির পরিমাণ কী, এটার একটা বিশ্লেষণ করতে বলা হয়েছে।”
বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সুন্দরবন এলাকায় পর্যটন বন্ধ রাখতে একটি নীতিমালা করার বিষয়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়।
মানুষের গৃহবন্দিত্বে হাঁফ ছেড়েছে খাঁচাবন্দিরা
লকডাউনের মধ্যে ঢাকা চিড়িয়াখানায় হরিণের দল।
এদিকে পরিবেশ ও বন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২৫ দিন বন্ধ থাকায় চিড়িয়াখানার প্রাণীদের খাবার গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে।
শান্ত পরিবেশে মায়ের নিবিড় সংস্পর্শে থাকার কারণে রোগ সংক্রমণ এবং শাবক মৃত্যুহার কমেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ হয়।
ঢাকার মিরপুরের ১৮৬ একরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় মহামারীর মধ্যে জন্মেছে ১১৬টি শাবক, যেখানে আগে ছিল ২৭০০ বন্য প্রাণী।
নতুন জন্মানো শাবকগুলোর মধ্যে রয়েছে- একটি জিরাফ, দুটি জলহস্তি, ১৮টি চিত্রা হরিণ, একটি মায়া হরিণ, একটি ঘোড়া, দুটি ইম্পালা, দুটি গাধা, একটি কমন ইল্যান্ড, ২৩টি ময়ূর, ১৩টি ইমু, ৩০টি বক, সাতটি ঘুঘু ও ১৫টি কবুতর।
কক্সবাজারের নির্জন সৈকতে এল গোলাপি ডলফিন
প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারের লাবনী পয়েণ্ট থেকে মাদারবুনিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত শামুক-ঝিনুক, রাজ কাঁকড়া ও তারামাছের ব্যাপক বিচরণ দেখা গেছে। সামুদ্রিক কাছিমের ডিম আগের চেয়ে তিন গুণ বেশি পাওয়া গেছে। বিগত বছরগুলোতে প্রায় ৫-৬ হাজার ডিম পাওয়া যেত।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, পর্যটকদের বিচরণ ছিল না বলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ফিরে এসেছিল ‘স্যান্ড ডিউন ভেজিটেশন’। সমুদ্র উপকূল রক্ষায় এ সকল গুল্মের ভূমিকা অনন্য। সৈকতের কাছে ডলফিনের বিচরণের কথাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে; যে খবর গণামধ্যমেও এসেছিল।