ক্যাটাগরি

দেশীয় ওয়েব সিরিজের মাপকাঠি হবে ‘তাকদীর’: চঞ্চল চৌধুরী

চলতি বছরের মাঝামাঝিতে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি ওয়েব সিরিজ নিয়ে নির্মাতা-অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে বিতণ্ডা ও বিতর্কের জেরবারে ওয়েব সিরিজ কেমন হবে-তা নিয়ে নির্মাতা, প্রযোজকদের মধ্যে সংশয় ছিল; তরুণ নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকী পরিচালিত ওয়েব সিরিজ ‘তাকদীর’-কে দেশের ওয়েব সিরিজের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করছেন চঞ্চল চৌধুরী।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো ‘তাকদীর’-এর রিভিউতে সয়লাব; এই প্রথম বাংলাদেশের কোনও ওয়েব সিরিজ নিয়ে এমন ইতিবাচক আলোচনা চলছে। ব্যক্তিগতভাবে আপনি কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?

চঞ্চল চৌধুরী: বাংলাদেশ ও ভারতের দর্শকদের মধ্যেই সমান উত্তেজনা কিংবা ভালোবাসা, ইতিবাচক আলোচনা দেখছি। ফেইসবুকে অনেকে আমাকে নিয়ে বা তাকদীরকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। টিমের আরও যারা ভালো করেছেন তাদের নিয়েও ইতিবাচক আলোচনা হচ্ছে।

বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের যাত্রা খুব বেশি দিনের নয়; চলতি বছরের মাঝামাঝির দিকে তিনটি ওয়েব সিরিজ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তার বিপরীতে দেশের ওয়েব কনটেন্টের ক্ষেত্রে ‘তাকদীর’ একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ তৈরি করেছে বলে মনে করছেন অনেকে।

চঞ্চল চৌধুরী: আমাকে অনেকদিন ধরে ওয়েব সিরিজে কাজ করার জন্য বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে অনুরোধ করেছে, আমি সেই ধরনের কনটেন্ট পাইনি যেই ধরনের কনটেন্টে কাজ করলে সেটা একটা মানদণ্ড নির্ধারণ করে। আমি যাচাই-বাছাই করেছি, গড়পড়তা কাজ করতে চাইনি।

মাঝে যেহেতু ওয়েব সিরিজ নিয়ে অনেক সমালোচনা তৈরি হয়েছিল। কী বলব, ওয়েব সিরিজ মানেই অন্য ধরনের কিছু! একটু অ্যাডাল্ট কনটেন্ট হয়, না হলে দর্শক দেখে না। টাকা পয়সা খরচ করে ভিউ বাড়ানোর জন্য এগুলোই করেছে। কিন্তু ভালো কনটেন্ট দিয়েও জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায় সেটার উদাহরণ তৈরি করার জন্য ‘তাকদীর’-এ কাজ করেছি।

ওয়েব সিরিজ নিয়ে যখন সমালোচনা চলছিল তখনই এটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল দেশে ওয়েব সিরিজের যে যাত্রাটা শুরু হয়েছে সেটার মাপকাঠি হিসেবে কাজ করবে ‘তাকদীর’। স্ট্যান্ডার্ডটা মানুষ মাথায় রাখবে। ‘তাকদীর’ যে মানের সেই মানের কাজ করার সক্ষমতা আমাদের নির্মাতাদের আছে।

আমাদের ভেতর সততা, কাজের প্রতি ভালোবাসা ও নিষ্ঠা দিয়ে ভালো কিছু করতে চাইলে অবশ্যই সম্ভব। সস্তা কিছু বিষয় অহেতুক এনে দর্শকদের সুড়সুড়ি দিয়ে অথবা সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে সেই জায়গাটায় আমার মনে হয় এই কাজের (তাকদীর) পর একটু অবসান হবে।

সেই জায়গাটা থেকে আমাদের ভালো ভালো নির্মাতাদের বেশিরভাগই সংশয়ে আছেন। বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজই বানাতে হবে। সেটা দেখার পর মানুষ বলবে, এটা বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজ। সিনেমা তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই হয়, বাংলাদেশের সিনেমার আইডেন্টিটি থাকতে হবে।

ওয়েব সিরিজ যেখান থেকে শুরু হয়েছে তারা যেভাবে ওয়েব সিরিজ করেছে কিংবা ইন্ডিয়া যেভাবে করছে আমাদেরও সেইভাবে করতে হবে এমনটা না; আমি আমার দেশের কনটেন্ট, কালচার, দর্শককে মাথায় রেখে আমার দেশের ওয়েব সিরিজ করব।

‘তাকদীর’ দেখার পর দেশের দর্শকরা শতভাগ স্বীকার করবেন, এটা আমাদের গল্প; আমাদের দেশে এটি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি ওটিটি প্লাটফর্ম রয়েছে; নতুন আরও কয়েকটি প্লাটফর্ম হচ্ছে। সবাই যেন তাদের গুণগতমান এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেন।

দেশে বেশ কয়েকটি ওটিটি প্লাটফর্ম থাকার পরও ‘তাকদীর’-এ বিনিয়োগ করেছে ভারতীয় ওটিটি প্লাটফর্ম হইচই; সিরিজের কনটেন্ট, আর্টিস্ট, নির্মাতা থেকে শুরু করে সবই বাংলাদেশের; তাহলে এর আয়োজন আমরা করতে পারলাম না কেন?

চঞ্চল চৌধুরী: আমরা কিছুই করতে পারি নাই। কিন্তু এটা আমাদের পক্ষে পারা সম্ভব। ইন্টারনেটের কারণে এখন বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া কিংবা অমুক দেশের কোনও ভেদাভেদ নাই। আকাশ সংস্কৃতির কারণে সারা পৃথিবী এক হয়ে গেছে। এই জায়গাটায় যে যার কোয়ালিটি দিয়ে জায়গাটা দখল করে রাখবে সেটা তার কৃতিত্ব।

আমরা সেখানে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা অবশ্যই পারতাম। কিন্তু এটা করার জন্য যা আয়োজন ও প্রস্তুতির দরকার সেটা করার মানসিকতা আমাদের তৈরি হয়েছে কি না সেটা আসল কথা।

আমাদের দেশে আরও তিন চার বছর ধরে ওটিটি প্লাটফর্ম যাত্রা শুরু হয়েছে কিন্তু তারা কোন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন? তাদের আসলে উদ্দেশ্য কী? তারা যদি এই উদ্দেশ্যটাই নিত যে, আমরা ভালো কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে কোনও ধরনের ছাড় দেবো না। বাজেটেও ছাড় দেবো না; ভালো কিছু করতে গেলে তো ভালো বাজেট লাগবে।

এখন আমি বাজেট দেবো না, আমার মাথায় থাকবে অন্য কিছু, ভিউ ধরার জন্য গল্পের প্রয়োজনে আসা উচিত কী অনুচিত সেটা বাদ দিয়ে নানান কিছু ইমফোর্স করব-তাহলে তো হবে না। আরেকটা বিষয় হলো, এই কাজগুলো করার জন্য যে যোগ্য মানুষগুলো দরকার সেই মানুষগুলো বাংলাদেশে আছে। কিন্তু কাজ করার সেই সুযোগটা খুব কম।

সুযোগটা তো আসলে আমার হাতে থাকে না। আমি একজন অভিনেতা, আমার বড়জোড় ক্ষমতা আছে দশটা কাজের প্রস্তাব এলে একটা কাজ পছন্দ হলে করব বাকি নয়টা ফিরিয়ে দেবো। এই সেক্টরের প্রত্যেকটা মানুষের দায়বদ্ধতা আছে। নাটক, সিনেমা-এগুলো তো শিল্প, এটা আট-দশটা ব্যবসার মতো না। বাংলাদেশেও ওয়েব সিরিজটি করতে পারত কিন্তু করার জন্য যে মানসিকতার মানুষগুলো দরকার, যে প্রস্তুতি দরকার সেগুলো ছিল না বলে হয়নি।

এখন এটা দেখার পর দেশের ওটিটি প্লাটফর্মগুলো যদি মনে করে যে, বাংলাদেশ থেকেও ভালো কাজ তৈরি করা সম্ভব; তাহলে সেভাবেই পরিকল্পনা করবেন।

বিষয়টা নির্ভর করছে, দায়িত্বশীলরা সেটিকে কীভাবে দেখতে চান। তারা যেভাবে দেখতে চায় সেটাই হচ্ছে। তারা সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য যা করছেন তারা সস্তা জনপ্রিয়তাই পাচ্ছেন কিন্তু সেটার মান নিয়ে হয়তো ভাবছেনই না।

‘তাকদীর’ পরবর্তী সময়ে দেশের ওয়েব কনটেন্টের ভবিষ্যত কেমন দেখছেন?

চঞ্চল চৌধুরী: কোয়ালিটি কাজ করলে সবকিছুই ফিউচার আছে। একসময় আমাদের সিনেমারও ভালো ভবিষ্যত ছিল কিন্তু সেটা আস্তে নিজেদের অসততা, স্বার্থপরতার কারণে নষ্ট করেছি। শিল্পের সঙ্গে কখনও অসততা চলে না। শিল্পের সঙ্গে অসততা করলে তখন সেটা শিল্পও হয় না, কোনও কিছুই হয় না।

ওটিটি প্লাটফর্মগুলোরও ভবিষ্যত আছে, টেলিভিশনের বিকল্প কিছু একটা কিছু হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা পড়ে গেছে, দর্শকরা খুব একটা আগ্রহ নিয়ে এখন আর টিভি নাটক দেখে না। ওয়েব কনটেন্ট যদি আবার টেলিভিশনের মতোই একটা করে চ্যানেল হয়ে বসে, এখানে একই স্ট্র্যাটেজিতে কাজ হয় তাহলে বাংলাদেশে ওটিটি প্লাটফর্ম টিকবে না। আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে; সেই সঙ্গে ভাবনা-চিন্তাকে অনেক প্রসারিত করতে হবে।

হঠাৎ করে ভালো দুয়েকটা কাজ এলেই ইন্ডাস্ট্রিতে পরিবর্তন আসে না। ওয়েব সিরিজ হিসেবে ‘তাকদীর’ একটা জায়গা পাওয়া মানে এটা শুধু আমার জায়গা না, এটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য এক ধাপ আগানো। আজকে ‘আয়নাবাজি’র কত বছর পরে একটা ‘দেবী’ হয়। আজকে ‘মনপুরা’র কত বছর পর ‘আয়নাবাজি’ হয়।

বিকল্পধারার সিনেমার দর্শকদের ঢল শুরু হলো ‘মনপুরা’ দিয়ে। এই কাজটি দর্শকদের হলে আনা শুরু করল তারপর সেটা ধরে রাখার দায়িত্ব ছিল। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো ভালো ডিরেক্টররা আছে, তারা যদি কাজ করতেন তাহলে এটার ধারাবাহিকতা থাকত, সেটা হয়নি।

এখন ‘তাকদীর’ হলো, ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো কিছু করার সুযোগ এলো; এটাকে কাজে লাগাতে হবে। এটা একজন আর্টিস্ট, একজন ডিরেক্টরকে দিয়ে হবে না, ইন্ডাস্ট্রিটা অনেক বড়। সবার মনমানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে, ভালো কাজের দিকে একটু ফোকাস করতে হবে।

আমাদের সমস্যা হলো, কাজের দিক বাদে ব্যবসার দিকে ফোকাস বেশি। অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলেও সিনেমার বানানোর জন্য এক কোটি টাকা ফান্ডিং করেন না। এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় জড়িত আছে। যারা কাজ করবে তারা টাকা পেলেই ভালো কাজ করবে এমনটাও না। লোভটা সংবরণ করতে হবে, কাজটাকে প্রয়োরিটি দিতে হবে। একটা কথা আছে যে, কর্মেই মুক্তি। আমরা এই বিষয়টা কী আমরা বিশ্বাস করি?

আমরা অন্য চিন্তা করি। মাঝে মধ্যে ভালো কাজ কিন্তু হচ্ছে পরে আবার কাছিমের মতো হাত পা গুটিয়ে চলে যাচ্ছি আমরা। এখন আরও ওয়েব সিরিজ হবে, ওটিটি প্লাটফর্মগুলো দর্শককে টানতে চাইবে। টিকে থাকতে ভালো কাজ করতে হবে। সেটার একটা সূচনা বৃহৎ পরিসরে শুরু করল ‘তাকদীর’। এর আগে বাংলাদেশের কোনও ওয়েব কনটেন্ট নিয়ে এতো বেশি আলোচনা হয়নি।

আলোচনার সঙ্গে পাইরেসির কবলেও পড়েছে ‘তাকদীর’…

চঞ্চল চৌধুরী: এতক্ষণ অভিনেতা, নির্মাতাদের দায়িত্বের কথা বললাম। এখানে দর্শকদেরও দায়িত্ব আছে। ফেইসবুকে ঢুকেই দেখছি, লিংক শেয়ার করছেন অনেকে। আসলে হইচই এতো টাকা বিনিয়োগ করে কাজটি করেছে, অর্থ তুলতে পারলে পরবর্তীকে আরেকটি কাজে উৎসাহিত হবে। পাইরেসি না করে অল্প কিছু টাকা খরচ করে হইচইয়ে সাবস্ক্রিপশন করে সিরিজটি দেখবেন দর্শকরা, এটাই আশা করছি।