ক্যাটাগরি

দেশে ১৪ কোটি মানুষকে টিকা দিতে পরিকল্পনা তৈরি

তিন ভাগে (ফেইজ) মোট পাঁচ ধাপে এসব টিকা দেওয়া হবে, যেখানে প্রাধান্য পাবে কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিরোধে সামনের কাতারে থাকা মানুষ। আর এজন্য প্রয়োজন হবে ২৭ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ১৬ ডোজ টিকা (একজনকে দুই ডোজ করে)।

জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা খসড়াটি অনুমোদনের জন্য ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিশাল পরিকল্পনা করলেও তার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে সময়মত পর্যাপ্ত টিকা পাওয়ার উপর; আর তা যে সহজ হবে না, সেটা কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেনও স্বীকার করছেন।

যেভাবে দেওয়া হবে টিকা

প্রথম ফেইজের টিকা দুই দুই ধাপে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে খসড়ায়। প্রথম ফেইজের প্রথম ধাপে ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন টিকা পাবেন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন টিকা পাবেন।

প্রথম ফেইজের দুই ধাপে বিতরণ শেষে টিকা দেওয়া শুরু হবে দ্বিতীয় ফেইজ। এ পর্যায়ে টিকা পাবেন এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৮ জন, যা মোট জনসংখ্যার ১১ থেকে ২০ শতাংশ।

তৃতীয় ফেইজেও দুই ধাপে দেওয়া হবে নভেল করোনাভাইরাসের টিকা। এ পর্যায়ের প্রথম ধাপে জনসংখ্যার ২১ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জন টিকা পাবেন। আর শেষ ধাপে জনসংখ্যার ৪১ থেকে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ জনকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ নয় কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার আশা করছে। এই টিকা দেওয়া যাবে সাড়ে চার কোটি মানুষকে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা কিনতে গত ৫ নভেম্বর সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। এই টিকার প্রথম চালান ৫০ লাখ ডোজ আগামী জানুয়ারির মধ্যে আসতে পারে বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

এছাড়া জুন মাসের মধ্যে কোভ্যাক্সের আওতায় আরও ছয় কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাবে বলে গত সোমবার মন্ত্রিসভাকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

টিকায় যাদের অগ্রাধিকার

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, প্রথম ফেইজের প্রথম ধাপে টিকা পাবেন ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন। এই তালিকায় সবার আগে আছেন করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে কাজ করা সব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং স্বাস্থ্য খাতের স্বেচ্ছাসেবীরা।

# সম্মুখসারির
চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফারি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, প্যাথলজি ও ল্যাবের কর্মী, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, সাইকোথেরাপিস্ট, অ্যাম্বুলেন্সের চালকসহ চার লাখ ৬৩ হাজার ৩৬১ জনকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এরমধ্যে তিন লাখ ৩২ হাজার ২৭ জন সরকারি প্রতিষ্ঠানের।

#মহামারী
মোকাবেলায় সরাসরি জড়িত বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানাধীন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফারি, প্যাথলজি কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কমিউটিনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্স চালক মিলিয়ে সাত লাখ মানুষ।

# কোভিড-১৯ চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত নয় কিন্তু টিকা বিতরণ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যখাত সচল রাখায় জড়িত সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের এক লাখ ৫০ হাজার জন।

# বীর
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুই লাখ ১০ হাজার জন।

# সম্মুখসারিতে
কাজ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৯ জন সদস্য। এর মধ্যে দুই লাখ ১২ হাজার ছয়জন পুলিশ। বাকিরা আনসার ও ভিডিপির নিয়মিত এবং প্রশিক্ষিত সদস্য।

# সশস্ত্র
বাহিনীর তিন লাখ ৮ হাজার ৭১৩ জন সদস্য প্রথম ধাপে টিকা পাবেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ২৭৪৯১৩ জন, নৌবাহিনীর ২২০০০ জন, বিমানবাহিনীর ১৪০০০ জন, বিজিবির ৫০০০০ হাজার সদস্য।  খসড়ায় বলা হয়েছে, র‌্যাব সদস্যদের নিয়োগ পুলিশ ও সেনাবাহিনী থেকে হয়ে থাকে। তাই এই বাহিনীর কর্মকর্তারা নিজস্ব বাহিনীর আওতায় টিকা পাবেন। প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা সেনাবাহিনীর আওতায় টিকা পাবেন।

# সরকারের
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৫০০০ হাজার কর্মকর্তা।

# সাংবাদিক
ও গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে ৫০,০০০ জন শুরুতে টিকা পাবেন। তবে এক্ষেত্রে যারা ফ্রন্টলাইনার হিসেবে মাঠে কাজ করছেন তারা অগ্রাধিকার পাবেন।

# ৬৮,২৯৮ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও শুরুতে টিকা পাবেন। এরমধ্যে রয়েছেন সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর এবং জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।

# সিটি
করপোরেশন এবং পৌরসভার এক লাখ ৫০ হাজার কর্মী, যারা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিষ্কাশন এবং মশক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন।

# পাঁচ
লাখ ৮৬ হাজার ধর্মীয় নেতাও সবার আগে করোনাভাইরাসের টিকা পাবেন। এই তালিকায় আছেন মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডার পুরোহিতরা।

# দাফন
ও সৎকারে নিয়োজিত ৭৫ হাজার কর্মীকে প্রথম ধাপে টিকা দেওয়া হবে। খসড়া পরিকল্পনায় বলা হয়েছে তারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিসহ মৃতদের দাফন ও সৎকারে নিয়োজিত, বিধায় ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।

# বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি, ফায়ার সার্ভিসের সাড়ে তিন লাখ কর্মী।

# বিমান,
স্থল এবং সমুদ্র বন্দরের কর্মীরা বিদেশ ফেরত এবং বিদেশগামীদের সংস্পর্শে আসেন। এ কারণে এই শ্রেণিকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে বিভিন্ন বন্দরের দেড় লাখ কর্মীকে শুরুতে টিকা দেওয়া হবে।

# এক
লাখ ২০ অপ্রশিক্ষিত প্রবাসী কর্মীকেও করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হবে। বলা হয়েছে, নিম্ন আয়ের এই প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের পরিবারের রোজগারের একমাত্র উৎস।

# জেলা
এবং উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত ৩ লাখ ৫০ হাজার সরকারি কর্মী, যারা জরুরি সেবা দিচ্ছেন তারাও টিকা পাবেন।

# প্রথম
পর্যায়ে টিকা পাবেন এক লাখ ৯৭ হাজার ৬২১ জন  ব্যাংকারও। খসড়া পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ব্যাংকাররা দেশের অর্থনৈতিক সেবায় যুক্ত রয়েছেন। তাদের সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি।

# এইডস,
যক্ষ্মা এবং ক্যান্সারের মতো রোগের ওষুধ গ্রহণের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে এমন পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার মানুষও প্রথম পর্যায়ে টিকা পাবেন।

# রোহিঙ্গা
ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী ২৬ হাজার ৭২১ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, তারা সংক্রমণের অধিক ঝুঁকিতে রয়েছেন।

খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী এক লাখ ১৯৪৯ জনকে দেওয়ার মতো টিকা সংরক্ষণে রাখা হবে, যা ব্যবহার হবে জরুরি ও মহামারী সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম ফেইজের দ্বিতীয় ধাপে টিকা পাবেন এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন। এই ধাপে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের।

২০২১ সালের মধ্যে দেশে ৬০ বছর অথবা তারচেয়ে বেশি বয়সের সম্ভাব্য জনসংখ্যা এক কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার ৩৬৯ জন হিসাব করা হয়েছে। এটি দেশের মোট জনসংখ্যার আট দশমিক দুই শতাংশ বলে ধারণা করছে খসড়া প্রণয়ন কমিটি।

প্রথম ফেইজের দ্বিতীয় ধাপে সাত শতাংশ হিসেবে এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জনকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে। বাকি এক দশমিক ২ শতাংশ অন্যান্য ক্যাটাগরিতে টিকা পেতে পারেন।

বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন এবং যাদের চিকিৎসায় নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের প্রয়োজন হতে পারে এমন জনগোষ্ঠীকেও খসড়া পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে জানিয়েছেন, টিকার প্রাপ্তি সাপেক্ষে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব।

তিনি বলেন, প্রথমে যে টিকা আসবে তার দুই ভাগের এক ভাগ প্রথম ডোজ হিসেবে দেওয়া হবে। বাকীটা রেখে দেওয়া হবে দ্বিতীয় ডোজের জন্য।

“এমনভাবে টিকা দেব, যেন প্রথমবার দেওয়ার পর সেকেন্ড ডোজ দেওয়া যায়। এভাবে টিকা পাওয়া নিশ্চিত হলে প্রথম দ্বিতীয় ধাপ শেষ করা হবে। এভাবে প্রথম ফেইজে টিকা দেওয়ার পর দ্বিতীয় ফেইজে যাব।”

উন্নত বিশ্বের দেশগুলো টিকা মজুত করছে বলে খবর এসেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলো সহজে টিকা পাবে কি না- এমন প্রশ্নে মুশতাক হোসেন বলেন, “সব দেশকে এক জোট হয়ে দর কষাকষি করতে হবে।

“বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শতকরা ২০ শতাংশ মানুষের কাছে টিকা পৌঁছানোর লক্ষ্য ঠিক করেছে। সেটা পাওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে। টিকা প্রস্তুতকারক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোভ্যাক্সে যোগ না দিলে, ধনী দেশগুলো সহযোগিতা না করলে, গরিব দেশের মানুষকে টিকা দেওয়া কঠিন।”

সবার জন্য টিকা পাওয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের সক্ষমতাও কাজে লাগাতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, নতুন করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগের জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই এই পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়েছে।

“সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশই ন্যাশনাল ডেপ্লয়মেন্ট প্ল্যান্ট। এখন মাইক্রো লেভেলে প্ল্যানিংয়ের কাজ করছি আমরা, টিকা ছাড়াও অন্যান্য প্রকিউরমেন্ট যা লাগে তা নিয়ে।”

সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা যেদিন ভারত পাবে, সেদিন বাংলাদেশও পাবে। সেরাম ইনস্টিটিউট ভারত সরকারের কাছে টিকার অনুমোদনের জন্য আবেদনও করেছে।

“তারা আশা করছে ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুমোদন পেয়ে যাবে। আমাদের এমনই জানিয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউট। ভারত সরকার অনুমোদন দিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জরুরি ভিত্তিতেই অনুমোদন দিয়ে দেবে।”