সেখানে বলা হয়েছে, দেশে এ বছর অতিবৃষ্টিতে কয়েক দফা বন্যায়
৩৫টি জেলার আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সারা বছরের উৎপাদন ও চাহিদা বিবেচনা করলে দেশে
খাদ্য ঘাটতির ‘আপাতত কোনো আশঙ্কা নেই’।
ব্রি’র ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা এম আব্দুল মোমিন বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত এক মাস ধরে দেশের ১৪টি কৃষি অঞ্চলে জরিপ করে তথ্য-উপাত্ত
বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইনস্টিটিউট এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।
“সারা দেশে চালের উৎপাদন কম এবং খাদ্য ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কার
কথা যেভাবে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, তা আদৌ ঠিক নয়।”
গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, এ বছর আউশ, আমন
ও বোরো মিলিয়ে মোট চাল উৎপাদন হবে ৩৭ দশমিক ৪২ মিলিয়ন টন।
“চাহিদা ও যোগানের অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিসেম্বর
২০২০ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত আভ্যন্তরীণ চালের চাহিদা মিটিয়ে ব্রির হিসাবে কমপক্ষে ৩০
লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।”
আব্দুল মোমিন বলেন, মাথাপিছু দৈনিক ৪০৫ গ্রাম চাল ধরে সর্বমোট
১৬ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার জন্য এই হিসাব করা হয়েছে। এছাড়া মোট ধান উৎপাদনের ২৬ শতাংশ
‘নন-হিউম্যান কনজাম্পশনের’ বাৎসরিক চাহিদা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
ব্রির মহাপরিচালক শাহজাহান কবিরের নেতৃত্বে এ গবেষণা দলে
ছিলেন জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবদুর রউফ সরকার, সিদ্দিকুর রহমান, আব্দুল আজিজ,
ইসমাইল হোসেন এবং প্রশাসন বিভাগের পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক।
মাঠ থেকে বাড়িতে নেওয়ার জন্য ট্রাক্টরে ধান তুলছে কৃষক। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
এ গবেষণায় বাংলাদেশের ১৪টি কৃষি অঞ্চল থেকে মোট ১ হাজার
৮০০ জন কৃষকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৫৬ জন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা
ও ১১২ জন উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তার কাছ থেকে ধানের আবাদ ও বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কিত
তথ্য নেওয়া করা হয়েছে। আমন ধানের আবাদকৃত এলাকার তথ্য বের করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে
স্যাটেলাইট ইমেজ।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ২০২০ সালের বন্যার তথ্য-উপাত্ত
বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছরই কম বেশি বন্যা হয়েছে দেশে, তবে গত ৪৮ বছরে
মধ্যে ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৭, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০
সালে বন্যায় প্লাবিত এলাকা ২২ শতাংশের বেশি ছিল।
গবেষকরা বলছেন, যখন কোনো বছর দেশে বন্যা দুর্গত এলাকা ২২
শতাংশ পেরিয়ে যায়, তখন ধানের উৎপাদন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৭০ টন হারে কমে যায়। অন্যদিকে
বন্যা দুর্গত এলাকা ২২ শতাংশের কম থাকলে পরবর্তী মৌসুমে উৎপাদন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে
৪৯০ টন হারে বৃদ্ধি পায়।
ধান কাটার শ্রমিক আগের মতো না মেলায় কৃষকদের কাছে চাহিদা বাড়ছে পেডি কাটারের। এ যন্ত্র দিয়ে কম সময়ে, কম খরচে ধান কাটা যায়। তাই কৃষকদের কাছে দিন দিন বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা। পেডি কাটার দিয়ে আমন ধান কাটার এ ছবি নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জের। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
গবেষণায় দেখা গেছে, যে বছরগুলোতে দেশ বন্যা দুর্গত হয়েছে,
তার পরবর্তী বছরে ধানের উৎপাদন বিভিন্ন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে সরকারের বিভিন্ন
ধরনের পদক্ষেপ এবং ধানের বাড়তি দাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ব্রি বলছে, গত বছরের তুলনায় ১৪টি কৃষি অঞ্চলের মধ্যে এ
বছর আমনের ফলন দিনাজপুরে ১১ দশমিক ১ শতাংশ, খুলনায় ৭ দশমিক ১ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১ দশমিক
৩ শতাংশ, এবং যশোরে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে বাকি ১০টি কৃষি অঞ্চলে
আমন ধানের ফলন বিভিন্ন হারে কমেছে। তবে এ বছর প্রতিটি কৃষি অঞ্চলে আমন আবাদের এলাকা
গত বছরের তুলনায় কম ছিল।
এ বছর ৫ থেকে ৬ ধাপে মোট ৩৫ জেলা বন্যায় কবলিত হয়েছিল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় মোট ১ লাখ ৫০০০ হেক্টর জমির আমন আবাদের
ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যে এলাকার বন্যা হয়নি, সেখানে ধানের
ফলন প্রায় ৪ দশমিক ৪ শতাশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কম, মাঝারি ও অতি বন্যাপ্রবণ এলাকায় ধানের
ফলন যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ শতাংশ এবং ২৪ দশমিক ১ শতাংশ কম
হয়েছে।
সব মিলিয়ে এবার আমন মৌসুমে চালের
গড় ফলন হবে প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৩০ টন। যে এলাকায় বন্যা হয়নি সেখানে গড় ফলন
প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৬৯ টন। আর কম দুর্গত এলাকায় প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৪২ টন, মাঝারি
দুর্গত এলাকায় হেক্টর প্রতি ২ দশমিক ১৮ টন এবং প্রবল বন্যা দুর্গত এলাকায় হেক্টর প্রতি
১ দশমিক ৯৪ টন ফলন হয়েছে।
ব্রির গবেষকরা বলছেন, উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে পাওয়া আবাদকৃত
এলাকা এবং ফলন বিবেচনায় নিয়ে আমনের উৎপাদন প্রাক্কলন করলে দেখা যায়, এ বছর চালের উৎপাদন
গত বছরের তুলনায় প্রায় ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ কম হয়েছে।
ট্রাক্টর বোঝাই করে ধান নিয়ে কৃষক ফিরছে বাড়ি। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
এর কারণ ব্যাখ্যা করে কৃষিবিদ আব্দুল মোমিন বলেন, “বন্যার
পাশাপাশি এ বছর ধান উৎপাদন বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিল, যার মধ্যে কোভিড-১৯,
আম্পান, অতি বৃষ্টি এবং বিভিন্ন রোগবালাই উল্লেখযোগ্য।”
ধান
উৎপাদন নির্বিঘ্ন করতে
ব্রির সুপারিশ
আগামী বোরো মৌসুমে আবাদ নির্বিঘ্ন করতে বেশ কয়েকটি সুপারিশও
উত্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিবেদনে।
ব্রি বলছে, এ বছর যেসব এলাকায় বন্যা হয়েছে, সেসব জায়গায়
প্রয়োজনীয় বীজ, চারা ও সারসহ সকল উপকরণ যথাসময়ে সরবরাহ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্রি,
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে (বিএডিসি) সমন্বয়
করে কাজ করতে হবে।
# চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে কৃষকদের জন্য ধান ও চালের
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
# সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে। চাল আমদানির সিদ্ধান্ত
যৌক্তিকতা বিবেচনা করে নিতে হবে।
# বছর বছর বন্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোর
খাল ও নালা খনন ও পুনঃখনন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সারা বছর ধানের আবাদ এলাকায় সেচ
ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। সেচ প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে চালু করা এবং মৌসুমব্যাপী
কার্যকরের ব্যবস্থা করতে হবে।
# পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বিবেচনায় নিয়ে যৌক্তিকভাবে ধানের
আবাদ এলাকা নির্ধারণ করতে হবে।
# বোরো আবাদে বীজ, সার ও যান্ত্রিকীকরণে প্রণোদনা অব্যাহত
রাখতে হবে।
# ধান কাটা এবং পরবর্তীতে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষকের
কাছ থেকে সরাসরি আমন ধান কেনা বাড়াতে হবে। ধান ও চাল সংগ্রহ কার্যক্রমকে আরো গতিশীল
ও কৃষকবান্ধব করতে হবে। ধান কাটার পর দুই মাস কোনো ধরনের চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া
যাবে না, এক্ষেত্রে বাজার পঞ্জিকা অনুসরণ করা প্রয়োজন।
#দেশে অভ্যন্তরীণ চালের চাহিদা, যোগান ও মজুদ পরিস্থিতির
সামগ্রিক তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত এবং সহজপ্রাপ্য করতে হবে।