মহামারীর বিস্তার রোধে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই কমবেশি লকডাউন জারি করেছে- বন্ধ থেকেছে দোকানপাট, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যায়নি। ফিলিপিন্সেও এর ব্যতিক্রম হয়নি, বরং অনেক দেশের চেয়ে সেখানে বিধিনিষেধ ছিল আরও কড়া।
এই কড়াকড়ির ফলে দেশটিতে করোনাভাইরাসের বিস্তার কিছুটা কম রাখা গেলেও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। সীমিত পরিসরে জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা চালু থাকলেও তাতে কাজ হয়নি। যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় জন্মনিরোধক পিল সংকটে পড়ে অনেক নারীই অপরিকল্পিতভাবে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন।
একারণে দেশটিতে আগামী বছর স্বাভাবিক শিশু জন্মের পাশাপাশি প্রায় ২ লাখ ১৪ হাজার বাড়তি শিশুর জন্ম হতে চলেছে। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে আগামী বছর দেশটিতে জন্ম নিতে চলেছে ১৯ লাখ বা প্রায় ২০ লাখ শিশু। ‘ইউনিভার্সিটি অব দ্য ফিলিপিন্স পপুলেশন ইন্সটিটিউট’ এবং জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল শিশু জন্মের এই আনুমানিক হিসাব দিয়েছে।
ফিলিপিন্সের ৪১ বছর বয়সী নারী রোভেলি জাবালা অপরিকল্পিতভাবে দশম সন্তানের জন্ম দিতে চলেছেন। রোভেলি পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারার আগেই ৭ সন্তানের মা হন। এবার তিনি গর্ভধারন করেছেন লকডাউনের সময়ে।
বিবিসি জানায়, বিশ্বের যে কয়টি দেশ কোভিড-১৯ মহামারীর বিস্তার রোধে কঠোরতম লকডাউন জারি করেছিল ফিলিপিন্স তার একটি। ওই সময় দেশটির সড়কে সড়কে সেনাসদস্যরা অস্ত্রহাতে টহল দিয়েছে। সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে নানা জায়গায় পুলিশের চেকপোস্ট বসেছিল। পরিবারের মাত্র একজন সদস্য শুধুমাত্র খাবার কিনতে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি পেতেন।
জায়গায় জায়গায় কোয়ারেন্টিনের কারণে অনেকেই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে যেতে পারেননি, বহু ক্লিনিকও ছিল বন্ধ। জুনের দিকে লকডাউনের কারণে প্রায় ৬ লাখ নারী জন্মনিরোধক পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এভাবে ফিলিপিন্সজুড়ে রোভেলির মতো অনেক নারীই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন।
লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়তে থাকার মধ্যে এই লাখ লাখ শিশুর জন্ম দেশটির জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়েই বিরাজ করছে। যদিও ফিলিপিন্সে অতিরিক্ত শিশু জন্মের পেছনে কোভিড-১৯ ছাড়াও কাজ করছে আরও কিছু কারণ।
দেশটিতে এমনিতেই জন্মহার বেশি। রাজধানী ম্যানিলা লোকে লোকারণ্য। সেখানে ম্যানিলা বে থেকে সিয়েরা মাদ্রে পাহাড়ী অঞ্চলের মধ্যে এক কোটি ৩০ লাখ লোকের বাস। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেখানে গড়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করে। ফলে নগরীর সড়ক থেকে কারাগার সব জায়গাতেই উপচে পড়া ভিড়।
ফিলিপিন্সের বেশিরভাগ মানুষ খ্রিস্টান। সেখানে বিশেষ করে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং গর্ভপাত করা দুইই পাপ। সেকারণে অন্তঃসত্ত্বা অনেক নারীই কোভিড-১৯ এর এই কঠিন সময়েও পরিবার থেকে গর্ভপাতের অনুমতি পাচ্ছেন না।
এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিলিপিন্সে উচ্চ-শিশু জন্মহারের আরেকটি কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য। কোভিডের এই সময়ে দারিদ্র্য আরও বেড়েছে। গরিব জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে যৌন শিক্ষার অভাব আছে এমনকী জন্মনিরোধকও তাদের কাছে সহজলভ্য নয়।
দারিদ্র্য বিমোচন এবং পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সরকার বহুদিন ধরে কাজ করে যতটুকু সফলতা অর্জন করছিল কোভিডের কারণে তাও এখন ভেস্তে যেতে বসেছে।
দেশটির ‘কমিশন অন পপুলেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট’ (পিওপিসিওএম) এর নির্বাহী পরিচালক জুয়ান এন্টোনিও পেরেজ বলেছেন, “ওই কর্মসূচি নিয়ে চারবছর ধরে আমরা যে কাজ করে আসছি তার পুরোটাই নস্যাৎ হতে পারে। যার ফল হবে আরও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ।”
তিনি বলেন, “এ মুহূর্তে প্রতি দশজনে তিনজন হারে অপিরিকল্পিত গর্ভধারণ হচ্ছে। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে আগামী বছর অর্ধেক গর্ভধারণই অপিরিকল্পিত হতে পারে।”