শুক্রবার
বড়দিনের সকালে বাবা-মায়ের সাথে কাকরাইলের সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে প্রার্থনায় যোগ দিতে আসা সাইমুন বললো, “সান্তার (সান্তা ক্লজ) কাছ থেকে অনেক গিফ্ট পেয়েছি। কিন্তু বন্ধুদের দেখাতে পারছি না। আমি চাই ঈশ্বর আমাদের স্কুল খুলে দিক।”
সাইমুনের
মন খারাপ, আর বড়দের মনে
উদ্বেগ। এই উৎসবের দিনেও
অনেকের হৃদয়জুড়ে স্বজন হারানোর বেদনা।
তাই
দেশের খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা এবার যিশু খ্রিস্টের জন্মতিথি পালন করছেন করোনাভাইরাস মহামারী থেকে পরিত্রাণের জন্য বিশেষ প্রার্থনায়।
বড়দিনের
প্রার্থনায় অংশ নিতে শুক্রবার সকাল থেকেই শীতের কুয়াশা গায়ে মেখে রাজধানীর গির্জাগুলোতে সমবেত হতে শুরু করে নানা বয়সী মানুষ।
তবে
মহামারী পরিস্থিতিতে এবছর বড়দিনের আয়োজনে সেই আড়ম্বর ছিল না। মুখে মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধর্মীয় আচার পালন করেছেন সবাই।
কাকরাইল
সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে বরাবরের মতই যিশুর জন্মমুহূর্তের স্মরণে বানানো হয়েছে প্রতীকী গোশালা। ক্রিসমাস ট্রি থেকে ঝুলছে আলোর মালা। তবে নেই আগের মত ঝাঁকজমক।
সকাল
সাড়ে ৮টায় গির্জার ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠলে শুরু হয় সাম সংগীত।
এরপর জোহান সমাচার পাঠ, সার্বজনীন প্রার্থনা ও অর্ঘ্য বিতরণের
চিরাচরিত আনুষ্ঠানিকতা চলে।
মঙ্গলবাণী
পাঠের মাধ্যমে নিজের পরিশুদ্ধি এবং জগতের সব মানুষের জন্য
মঙ্গল কামনা করেন যিশু ভক্তরা। এ বছর করোনাভাইরাস
মহামারী থেকে বিশ্বের পরিত্রাণ চেয়ে বিশেষ প্রার্থনা করেন তারা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।
যিশুর
সত্য-ন্যায়ের আদর্শকে তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের
সাবেক চেয়ারম্যান ফাদার তপন কালিমুস ডি রোজারিও বলেন,
“পথভ্রষ্ট মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথ
দেখাতে এই দিনে পৃথিবীতে
যিশু খ্রিস্টের আবির্ভাব হয়েছিল। তিনি মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, সেবা, ক্ষমা, মমত্ববোধ, সহানুভূতি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাসহ
শান্তিপূর্ণ অবস্থানের শিক্ষা দিয়েছেন।
“বড়দিন
তার সেই আদর্শকে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। আামরা তার সেই আদর্শকে ধারণ করে সম্প্রীতি ও ঐক্য স্থাপনের
মাধ্যমে অশান্ত বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনব।”
সেন্ট
মেরিস ক্যাথেড্রালের সভাপতি ফাদার বিমল ফ্রান্সিস গোমেজ বলেন, “এ বছর আমরা
এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে বড়দিন উদযাপন করছি। স্বাস্থ্য বিধি মেনে সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
“ধর্মীয়
আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে যেসব বিষয়ে লোকসমাগম হয়, সে ধরনের উদযাপনে
ভক্তদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় আমাদের সুদিন আসবে এবং তখন একটি সুন্দর-সুস্থ্য পৃথিবীতে আমরা মহা আড়ম্বরে যিশুখ্রিস্টকে স্মরণ করব।”
খ্রিস্ট
ধর্ম প্রচারক যিশু খ্রিস্টের জন্মকাহিনি বড়দিনের উৎসবের মূলভিত্তি। ২৫ ডিসেম্বর বেথলেহেম
শহরে কোনো এক গোশালায় কুমারী
মাতা মেরির গর্ভে জন্ম নেন যিশু।
প্রথা
অনুযায়ী বড়দিনের আগের রাতে বিভিন্ন গির্জা ও উপাসনালয়ে প্রার্থনার
মধ্য দিয়ে শুরু হয় ধর্মীয় আচারের
আনুষ্ঠানিকতা। রাত ১২টা এক মিনিটে কেক
কেটে উদযাপন করা হয় যিশু খ্রিস্টের
জন্মদিন।
বড়দিনকে
কেন্দ্র করে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে নানা আয়োজন করেন। সকালে প্রার্থনা শেষে সারা দিন আনন্দ-উৎসব ও আমেজের মধ্য
দিয়ে দিনটি উদযাপন করেন তারা। তবে এবার অনেক কিছুই হবে ‘সীমিত পরিসরে’।
প্রতিবছর
বড়দিন উপলক্ষে রাজধানীর গির্জাগুলো ছোট বড় নানা বয়সীর
মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। এবছর করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ততটা ভিড় না থাকলেও অনেকেই
পরিবার-পরিজন নিয়ে গির্জায় এসেছেন।
মোহাম্মদপুর
এলাকা থেকে স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে প্রার্থনায় যোগ দিতে এসেছিলেন জোনাথন গোমেজ ।
তিনি
বললেন, “আমরা একটি কঠিন সময় পার করছি। এই অবস্থা থেকে
উত্তরণ হবে আমাদের জন্য ঈশ্বরের বড় কৃপা। তাই
এবার প্যানডেমিক থেকে মুক্তির জন্য বিশেষভাবে প্রার্থনা করেছি।”
গত
৩৪ বছর ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে এসে বড়দিনের প্রার্থনা সারেন মগবাজারের দিনা গোমেজ। এবছর স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে পরিবারের অন্য কেউ না এলেও তিনি
একাই এসেছেন, প্রার্থনা করেছেন মানুষের ‘মঙ্গলের জন্য’।
“অনেক
মানুষের সাথে এখানে বড়দিনের প্রার্থনা করতাম। এটা আমাদের একটা বড় মিলন মেলাও
বটে। এখানে অনেক মানুষের সমাগম হত, অনেকে সাথে পরিচয় হত। তারা আজ অনেকে নেই।
হয়ত করোনায় অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। যাই হোক, যে যেখানে থাকুক,
সবার মঙ্গল হোক।”