সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে আর্চবিশপ বিজয় এন ডি ক্রুজ বলেছেন, “যিশু
খ্রিস্টের আগমন বয়ে আনুক অনেক আশা, সুস্থতা, নতুন জীবন ও আনন্দ। বিশ্ব মুক্ত হোক এই
নিষ্ঠুর করোনাভাইরাসের হাত থেকে। সমস্ত অসত্য, অন্ধকার, ভয়, মিথ্যা, অত্যাচার দূরিভূত
হোক। মানুষ লাভ করুক প্রকুত সুখ ও শান্তি।”
খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারক যিশু খ্রিস্টের জন্মকাহিনি বড়দিনের উৎসবের মূলভিত্তি।
২৫ ডিসেম্বর বেথলেহেম শহরে কোনো এক গোশালায় কুমারী মাতা মেরির গর্ভে জন্ম নেন যিশু।
খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস, যিশু এ পৃথিবীতে এসেছিলেন মানবজাতিকে পাপ, অসত্য
ও অন্যায় থেকে মুক্তি দিতে। ভালোবাসা, সেবা, ন্যায্যতা, ঈশ্বরের বিশ্বাস ও প্রতিবেশী
প্রেমের উপর ভিত্তি করে তিনি নতুন মানবসমাজ গঠন করেছেন।
বড়দিন উপলক্ষে রাজধানীর গির্জাগুলো সাজানো হয়েছে মনোরম সাজে। ক্রিসমাস
ট্রি থেকে ঝুলছে আলোর মালা। বানানো হয়েছে খ্রিস্টের জন্মের ঘটনার প্রতীক গোশালা। সেই
সঙ্গে বড় দিনের কেক তো আছেই।
বড়দিন শুক্রবার হলেও আগের রাত থেকেই উৎসবে মেতে ওঠেন খ্রিস্টানরা, তাদের
বাড়ি বাড়ি শুরু হয় উৎসব। পাশাপাশি অভিজাত হোটেলগুলোতেও ছিল বিশেষ আয়োজন।
বড়দিনের সকালে শুক্রবার ঢাকার ফার্মগেইটের হলি রোজারি চার্চে প্রার্থণায় শিশুরাও।
রাজধানীর কাকরাইলের সেন্ট ম্যারিস ক্যাথিড্রাল, ফার্মগেটের পবিত্র জপমালা
রানীর গির্জা, মহাখালীর লুর্দের রানীর গির্জা, লক্ষ্মীবাজারের ক্রুশ ধর্মপল্লী, মোহাম্মদপুরের
সেন্ট ক্রিস্টিনা গির্জা, মিরপুর-২ এর মিরপুর ক্যাথলিক গির্জা, কাফরুলের সেন্ট লরেন্স
চার্চে বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকেই বড়দিনের প্রার্থনা শুরু হয় বলে বাংলাদেশ খ্রিস্টান
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও জানান।
শুক্রবার সকালে সবগুলো চার্চে নববর্ষের জন্য বিশেষ প্রার্থনায় যোগ দেয়
নানা বয়সী মানুষ। নিরাপত্তার সতর্কতার সঙ্গে এবার গির্জায় গির্জায় ছিল স্বাস্থ্যবিধির
সতর্কতা।
বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন, মহামারীর মধ্যে এবার গির্জায় প্রার্থনা শেষ করে দীর্ঘ সময় অবস্থান করার
সুযোগ নেই।
“বড় দিনের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি তো আমরা নিয়েছি, কিন্তু বাহ্যিক প্রস্তুতি
আমাদের সীমিত করতেই হয়েছে। এ বছর প্রভুর কাছে আমরা প্রার্থনা করছি, সারা পৃথিবী যেন
মহামারীর কবল থেকে খুব দ্রুত মুক্ত হয়। সামনের বছরটি যেন আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে আবার
বড় দিন উদযাপন করতে পারি।”
বড়দিন উপলক্ষে দেওয়া এক বার্তায় আর্চবিশপ বিজয় এন ডি ক্রুজ ভোগবাদী মানসিকতা,
আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করে এই বিশ্ব প্রকৃতির যত্ন নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
“পূণ্য পিতা এ বছরটিকে ‘লাউদাতো সি’ বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই বর্ষ
পালনের উদ্দেশ্য হল, আমরা যেন আমাদের মাতৃস্বরূপ ধরিত্রী, সবার বসতবাটীকে আপন করে নেই
ও বিশ্ব প্রকৃতির যত্ন করি।
খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিষ্ট আজকের দিনে বেথলেহেম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার ফার্মগেইটের হলি রোজারি চার্চে জন্মের সময়ের আদলে সাজানো হয়েছে।
“মানুষের অতিমাত্রায় ভোগবাদী মনমানসিকতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা,
লোভ-লালসা এবং উদাসিনতার কারণে সৃষ্টি-প্রকৃতি বন-বৃক্ষনিধন, বাতাসে অতিমাত্রায় কার্বন
ডাই অক্সাইড, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ ও দুর্গন্ধময় জল, জলাবদ্ধতা, খাল-ডোবা নিশ্চিহ্ন
হওয়া, শব্দ দূষণ, কালো ধোয়া, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের
নেতিবাচক প্রভাব গোটা মানবজাতি ও প্রকৃতিকে বিপর্যয় ও অকল্পনীয় বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই ক্ষতবিক্ষত ধরিত্রীও যেন প্রতিশোধ নিতে উদ্যত।
“প্রকৃতি ও মানুষের এই দূরাবস্থার জন্য্য মানুষই দায়ী। এর প্রতিকারের জন্য
মানুষকে বিবেকী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মানুষকে গণমঙ্গলের কথা চিন্তা করতে হবে।”
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের
বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতির বাণী
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার বাণীতে বলেন, জাতিতে জাতিতে সম্প্রীতি ও ঐক্য
স্থাপনসহ অশান্ত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যিশু খ্রিস্টের শিক্ষা ও আদর্শ ‘খুব প্রাসঙ্গিক’।
“তিনি ছিলেন সত্যান্বেষী, মানবজাতির মুক্তির দূত এবং আলোর দিশারি। স্রষ্টা
ও সৃষ্টির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের পাশাপাশি পৃথিবীকে শান্তির আবাসভূমিতে পরিণত করতে
তিনি বহু ত্যাগের বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তার মহিমা ও খ্রিস্টধর্মের সুমহান বাণী প্রচার করেন।
“তিনি পথভ্রষ্ট মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আহ্বান জানান। মানুষের মধ্যে
ভালোবাসা, সেবা, ক্ষমা, মমত্ববোধ, সহানুভূতি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাসহ শান্তিপূর্ণ অবস্থানের
শিক্ষা দেন। জাগতিক সুখের পরিবর্তে যিশু খ্রিস্ট ত্যাগ, সংযম ও দানের মাধ্যমে পরমার্থিক
সুখ অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।”
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিনে ঢাকার ফার্মগেইটের হলি রোজারি চার্চ ঘিরে নেওয়া হয়েছে নিরাপত্তা।
আবদুল হামিদ বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল
দৃষ্টান্ত। এখানে সবধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম ও আচার ও অনুষ্ঠানাদি স্বাধীনভাবে পালন
করে আসছে। বিদ্যমান সম্প্রীতির এই সুমহান ঐতিহ্যকে আরো সুদৃঢ় করতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে
সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখতে হবে।
“জাতির পিতা একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমি একটি
সুখী-সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানাই।”
প্রধানমন্ত্রীর
বাণী
বড়দিন উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যিশু খ্রিস্টের
জীবনাচারণ ও দৃঢ় চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য মানব ইতিহাসে তিনি ‘অমর’ হয়ে আছেন।
“পৃথিবীতে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা
প্রবর্তনই ছিল যিশু খ্রিস্টির অন্যতম ব্রত। বিপন্ন ও অনাহারক্লিষ্ট মানুষের জন্য মহামতি
যিশু নিজেকে উৎসর্গ করেন।”
সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান
বলেন, “আসুন, সকলে মিলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে সাম্প্রদায়িক সকল অপশক্তির
বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ
গড়ে তুলি।
“ধর্ম যার যার, উৎসব সবার- এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আমরা সবাই একসঙ্গে উৎসব
পালন করব। আমাদের সংবিধানে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
সকলে মিলে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। তাই এই দেশ আমাদের সকলের। বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ
নির্বিশেষে সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি।”