জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে শনিবার নাগরিক
শোকসভায় এ দাবি তোলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী,
যিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন।
জাফরুল্লাহ বলেন, “আজ যারা ইতিহাস লেখেন, তারা
ইতিহাসের অংশ নন। ইতিহস নির্মাণ করেন যে সাধারণ
মানুষ তাদের কথা আমরা ভুলে যাই। জুনোর ইতিহাস আমরা বুঝতে চাই না। জুনোর কথা, মুক্তিযুদ্ধে
তার অবদান যাতে কেউ ভুলে না যায় সেটার জন্য কাজ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। জুনোকে,
তার অবদানকে পাঠ্যবইতে আনতে হবে।”
কমিউনিস্ট নেতা হায়দার আকবর খান রণোর ছোট ভাই
জুনো গত ২৯ অক্টোবর মারা যান।
প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ নওশের আলীর নাতি জুনো
ভাইয়ের মতোই স্কুল জীবনেই কমিউনিস্ট রাজনীতির দীক্ষা নিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স করলেও রাজনীতিকেই পেশা হিসেবে নেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা হিসেবে প্রশিক্ষণ
নিয়েছিলেন জুনো। পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র জুনো তখন বোমা তৈরির কাজ করছিলেন। প্রয়াত আব্দুল
মান্নান ভূইয়াদের সঙ্গে তিনি নরসিংদীর শিবপুরে প্রতিরোধ যুদ্ধেও ছিলেন।
চিনপন্থি কমিউনিস্ট জুনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের
পাশাপাশি গণমুখী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতেও ভূমিকা রাখেন। গণ-সংস্কৃতি ফ্রন্টের
সভাপতি ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ কিউবা সংহতি কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব
পালন করেন।
শোকসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এখনকার সিপিবি
নেতা হায়দার আকবর খান রণো বলেন, “আমার ছোটভাই হিসেবে নয়, একজন সংগ্রামী মানুষকে স্মরণ
করে আমি বলতে চাই, সম্পদের মোহ, মমতা, প্রচার কোনো কিছুই জুনোকে কখনও আদর্শ থেকে বিচ্যুত
করতে পারেনি। চিনপন্থি দলগুলোর সমস্যার কারণে সে পার্টি থেকে সরে গেলেও কমিউনিস্ট আদর্শ
থেকে সরেনি। দলে না থাকলেও আদর্শে ছিলেন অবিচল।”
রনো ও জুনোর এক সময়ের রাজনৈতিক সঙ্গী ওয়ার্কার্স
পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।
তিনি বলেন, “জুনো এমন একজন কর্মী ছিলেন, যাকে
অনুসরণ করা যায়, যাকে নেতা মানা যায়। ছাত্র ইউনিয়ন যখন বিভক্তির মুখে পড়ে, তখন আমরা
জেলে, পার্টিকে রক্ষা করতে জুনো অক্লান্ত পরিশ্রম করে।
“১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকে সামনে
এগিয়ে নিতে জুনো এগিয়ে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখ যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতির
বিষয়ে জুনোর দুঃখ ছিল। অনেকে চেষ্টার পর তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
“চলে যাওয়ার সময় তিনি গান স্যালুট নিয়ে বিদায়
নিয়েছেন। আমরা তাতে স্বস্তিবোধ করেছি। আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করতে পারেনি।
আজ আমি বলে চাই, সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে হবে। একটা যথাযথ তালিকা করা
হোক।”
ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর বলেন, “এখানে
সব দলের নেতারা থাকলে ভালো লাগত। এরকম একজনের জীবন নিয়ে আলোচনার জন্য কার্পণ্য করা
উচিত নয়।
“হায়দার আনোয়ার খান জুনো একজন মুক্তিযোদ্ধা
ছিলেন। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধার
চিকিৎসা খরচ রাষ্ট্রকে বহন করার দাবি জানাচ্ছি।”
নূর মঞ্চে থাকা জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ভার্চুয়ালি
যুক্ত হওয়া মেননের উদ্দেশে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা এখনও চলছে।
এখানে কোনো আপস করা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে আছেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও রাশেদ
খান মেনন সাহেব আছেন। আমি নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে তাদের কাছে বিতর্কমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের
সঠিক ইতিহাস লেখার আহ্বান জানাই।”
বাম ছাত্র আন্দোলনের এক সময়ের নেতা ও বর্তমানে
বিএনপিতে যুক্ত জহির উদ্দিন স্বপন সভায় বলেন, “আমরা আজ এখানে যারা এসেছি, তাদের মধ্যে
রাজনীতির ভিন্নতা আছে। কিন্তু সকল ভিন্নমত ধারণ করে আমরা জুনো ভাইকে সম্মান জানাতে
এসেছি। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার আন্দোলনে জুনো ভাইয়ের অবদান স্মরণ
করতে হবে। আমরা যে যেখানেই যাই না কেন, রাজনীতিতে যেখানেই থাকি না কেন মুক্তিযুদ্ধের
আদর্শ, সততার জন্য জুনো ভাইকে শ্রদ্ধা করি।”
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী
মানিকের এক নিবন্ধের সমালোচনা করে বলেন, “তিনি বলেছেন, আমি বিএনপি করি। আমি কোনোদিন
বিএনপির সদস্য ছিলাম না। যারা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে আমি তাদের সাথে থাকি।
“আজকে এই নাগরিক শোকসভা যদি সরকার আয়োজন করত,
আমি খুশি হতাম।”
অনুষ্ঠানে
হট্টগোল
অনুষ্ঠানের শুরুতে গরীব মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি
শামসুজ্জামান মিলনের এক বক্তব্যে অনুষ্ঠানস্থলে হইচই শুরু হয়।
মিলন বলেন, “জুনো ভাই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা
ছিলেন। যেটা ছিল পিকিংপন্থি। অনেকে মেনন গ্রুপ বলেন। কিন্তু আমি তা বলব না। জুনো ভাই
কখনও আপস করেননি, দালালি করেননি।”
তার এই বক্তব্যের পর অনুষ্ঠানে থাকা ওয়ার্কার্স
পার্টির সমর্থকরা মিলনের দিকে তেড়ে যান। তার মাইক টেনে নামানোর চেষ্টা করেন।
মিলন এ সময় বলতে থাকেন, “জুনো ভাই বিপ্লবী
ছিলেন। তিনি বিপ্লবী ছিলেন। বিপ্লবীকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে।”
এসময় কয়েকজন মিলনকে চুপ থাকতে বললেও তিনি কথা
বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে মিলন মঞ্চ থেকে নেমে যান। তখন ওয়ার্কার্স পার্টির কয়েকজন তাকে
ধাক্কা দেন। এসময় প্রয়াত জুনোর মেয়ে অনন্যা লাবনী মাইকে সবাইকে শান্ত হতে বলেন।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে
যুক্ত হয়ে কারাবরণকারী জুনো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিলন। তার
ভাই রণো তখন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। পরে জুনো ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য
নির্বাচিত হন।
ষাটের দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া জুনো
ছিলেন চিনপন্থি শিবিরে। ১৯৭০ সালে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হলে তিনি এর সভাপতির দায়িত্ব
নেন।
স্বাধীনতার পর জুনো লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি ইউনাইডেট পিপলস পার্টির (ইউপিপির)
সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক হন। ১৯৭৯ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি গঠিত হলে দলটির কেন্দ্রীয়
কমিটির সদস্য হন তিনি।
শোকসভায় জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সভাপতি
মোস্তফা জামাল হায়দার, কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতা আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন, জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি জসীমউদ্দিন আহমেদ বক্তব্য রাখেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন নাগরিক
শোকসভা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক হারুন অর রশীদ।