তারা দুজনেই বলেছেন, ‘এস কে সিনহার কথাতেই’ তাদের নামে শাহজালাল ইসলামী
ব্যাংকের উত্তরা শাখায় হিসাব খোলা হয়েছে। পরে সেই হিসেবে সোয়া দুই কোটি টাকা স্থানান্তরের
বিষয়ে তারা ‘জানতেন না’।
৭০ বছর বয়সী নরেন্দ্র কুমার সিনহা সাবেক প্রধান বিচারপতির আপন বড় ভাই।
আর শঙ্খজিৎ সিনহা বিচারপতি সিনহার মামাতো ভাইয়ের ছেলে।
সোমবার ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ শেখ নাজমুল আলমের আদালতে তারা নিজেদের জবানবন্দি
তুলে ধরেন।
এদিন সাক্ষ্য গ্রহণের সময় মামলার অন্যতম আসামি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের
অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) অসুস্থ হয়ে পড়লে
তাকে পাশের ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে পাঠানো হয় কারাগারে।
২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটি নিয়ে দেশ ছাড়ার পর বিদেশ থেকেই পদত্যাগপত্র
পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। তাকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার
বিচার কাজ চলছে।
আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে তার ভাই নরেন্দ্র বলেন, তিনি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের
অধীন নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের প্রধান বাতি রক্ষক হিসাবে চাকরি করতেন। ২০০৫ সালের জানুয়ারি
মাসে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখায় তার এবং তার ভাতিজা শঙ্খজিতের যৌথনামে
একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে যে চার কোটি টাকার ঋণ আত্মসাতের
কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা নরেন্দ্র ও শঙ্খজিতের সেই
যৌথ হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা
নরেন্দ্র আদালতে বলেন, তার ভাই এস কে সিনহা একদিন তাকে বলেন, বিশেষ প্রয়োজনে
তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলো প্রয়োজন, কিন্তু সরকারি চাকরিতে থাকার কারণে তার পক্ষে
তা সম্ভব নয়।
সেজন্য এসকে সিনহার ‘অনুরোধে’ শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কিছু কাগজপত্রে
সই করেন বলে আদালতকে জানান নরেন্দ্র।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তিনি কখনোই ওই ব্যাংকে যাননি এবং কোনো চেকেও স্বাক্ষর
করেননি। শঙ্খজিতের সঙ্গে তার কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল না। সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম
কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার অ্যাকাউন্ট থেকে ওই যৌথ অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকার বিষয়ে
তার কোনো ‘ধারণাও নেই’।
ওই অ্যাকাউন্ট খোলার সময় কিছু কাগজপত্রে সই করা ছাড়া লেনদেন সম্পর্কে
‘কিছুই জানতেন না’ এবং এ সব বিষয়ে এস কে সিনহাই ‘এককভাবে অবগত ছিলেন’ বলে জবানবন্দিতে
উল্লেখ করেন তার ভাই।
নরেন্দ্রর সাক্ষ্যে যেহেতু বাবুল চিশতী বা অন্য কোনো আসামির নাম আসেনি,
সে কারণে এস কে সিনহার ভাইকে সাক্ষী হিসেবে জেরা করবেন না বলে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী
শাহীনুল ইসলাম অনিসহ অন্যরা।
পরে শুরু হয় শঙ্খজিতের সাক্ষ্য। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, কাকা এস কে সিনহার
‘অনুরোধে’ তিনি শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখায় যান এবং ওই শাখার ম্যানেজারের দেওয়া
কিছু কাগজপত্রে সই করেন।
শঙ্খজিত বলেন, ওই অ্যাকাউন্টে যত টাকা লেনদেন হয়েছে, সে বিষয়ে তার কোনো
‘ধারণা ছিল না’ এবং ওই টাকা তার কাকা সুরেন্দ্র সিনহা এবং সুরেন্দ্রর স্ত্রী লেনদেন
করেন।
জবানবন্দিতে শঙ্খ বলেন, কাকার নির্দেশেই তিনি ঢাকা ব্যাংক লিমিটেডের উত্তরা
শাখায় ৫০ লাখ এবং ১০ লাখ টাকার দুটি এফডিআর করেন এবং ১৪ লাখ টাকা ঢাকা ব্যাংকের ইপিজেড
শাখায় রাখেন।
তার সাক্ষ্য চলাকালে মামলার অন্যতম আসামি বাবুল চিশতী অসুস্থ হয়ে পড়েন
এবং কাঠগড়ায় ঢলে পড়েন।
তার আইনজীবী শাহীনুল ইসলাম অনি এবং দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম
এসময় দ্রুত তাকে ধরে হাসপাতালে নিতে আদালতের কর্মচারীদের অনুরোধ করেন।
এরপর শঙ্খজিতের সাক্ষ্যগ্রহণের মাঝপথেই শুনানি মুলতবি করে দেন বিচারক।
পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৩ জানুয়ারি দিন ঠিক করে দেন তিনি।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১৮ সাক্ষীর মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
আগামী তারিখে শঙ্খজিতের বাকি সাক্ষ্য শোনার পাশাপাশি হাই কোর্টের বেঞ্চ রিডার মো.মাহবুবের
সাক্ষ্যগ্রহণের কথা রয়েছে।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এই বেঞ্চ রিডারের মাধ্যমেই ব্যাংকে টাকা জমা করতেন
বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়।
এস কে সিনহা ছাড়া মামলার বাকি আসামিরা হলেন- ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে
পদ্মা ব্যাংক) অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী, ব্যাংকের
সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট
স্বপন কুমার রায়, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো.
লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রনজিৎ
চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়।
আসামিদের মধ্যে বাবুল চিশতী কারাগারে আছেন। শামীম, স্বপন, লুৎফুল, সালাহউদ্দিন,
শাহজাহান ও নিরঞ্জন আছেন জামিনে। আর এস কে সিনহা, সাফিউদ্দিন, রণজিৎ ও তার স্ত্রী সান্ত্রী
পলাতক।
ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম গত ১৩ অগাস্ট এই
১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।
তার আগে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্তকারী
কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনে এস কে সিনহার ব্যাংক
হিসাবের চার কোটি টাকা জব্দ করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের
মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে সেই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর,
উত্তোলন ও পাচার করেছেন, যা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ
আইনের ৫(২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২)(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য
অপরাধ।
দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী বা তার
প্রতিনিধির বিরুদ্ধে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন
কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে বিচারপতি সিনহা তিন বছর আগে বিদেশে পাড়ি জমানোর
পর দুদক অভিযোগ পায়, তিনি ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই
ব্যক্তির নেওয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন।
অভিযোগ পেয়ে ওই বছরই তদন্তে নামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তে পর ২০১৯ সালের ১০
জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন
চন্দ্র ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুইটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর
জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন।
তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২
নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তখনকার প্রধান
বিচারপতি এস কে সিনহা।
ঋণের জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের
৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে। ওই দম্পতি এস কে সিনহার পূর্ব পরিচিত
ও ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে।
দুদক বলছে, ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই
ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ৭ নভেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর ‘অস্বাভাবিক দ্রুততার’
সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয় এস
কে সিনহার নামে। ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার অ্যাকাউন্টে
জমা হয়।
পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা
হয়। এর মধ্যে এস কে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে
দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের ২৮ নভেম্বর।
এজাহারে বলা হয়, “আসামি রনজিৎ চন্দ্র ঋণ দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির
প্রভাব ব্যবহার করেন। রনজিৎ চন্দ্রের ভাতিজা হলেন ঋণ গ্রহীতা নিরঞ্জন এবং অপর ঋণ গ্রহীতা
শাহজাহান ও রনজিৎ ছোটবেলার বন্ধু। ঋণ গ্রহীতা দুইজনই অত্যন্ত গরিব ও দুস্থ। তারা কখনও
ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি।”
দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে বসেই
২০১৮ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে ‘পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে’
পাঠানো হয়েছে।
ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছিলেন
এস কে সিনহা। নিউ জার্সিতে ছোট ভাই অনন্ত কুমার সিনহার নামে কেনা একটি বাড়িতেই সে সময়
তিনি থাকছিলেন।
পরে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে খবর আসে সিনহা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় গিয়ে
সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন।
বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ
পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের
পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। বাকি বিষয়গুলো নিয়ে পরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।