চরম সংকটেও মানুষ যাতে পৃথিবী থেকে পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে বিদায় নিতে পারে- সেটাই ছিল তাদের চাওয়া। এই কাজ করতে গিয়ে আপনজনদের ছেড়ে স্বেচ্ছাসেবকদের বেছে নিতে হয়েছিল একঘরে জীবন। এতে উপকারভোগীরা কৃতজ্ঞতা জানালেও সমাজের কেউ কেউ তাদের দূর দূর করে তাড়াতে চেয়েছেন, তৈরি করেছেন নানা প্রতিবন্ধকতা। তবে সেগুলো মোকাবেলা করেই ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার পাশাপাশি একের পর এক মৃতদেহের সৎকার করেছেন তারা।
মুসলমান হয়েও হিন্দুর মুখাগ্নি করতে হয়েছে, স্বজনরা দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করা লাশ নিজ দায়িত্বে কবরে শুইয়েছেন এই স্বেচ্ছাসেবকের দল।
কবর খুঁড়ছেন নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ
এমন অচেনা এক সময় পাড়ি দেওয়া এই স্বেচ্ছাসেবকদের একজন নরায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপন ভাই, স্ত্রী, সন্তানরা সামান্য একটা ভাইরাসের ভয়ে এত অল্প সময়ে কাউকে ত্যাগ করতে পারে মহামারী না আসলে আমরা কেউ এটা বুঝতে পারতাম না।”
বিদায়ী ২০২০ সালের ৮ মার্চ ঢাকায় প্রথম কোভিড-১৯ রোগী ধরা পড়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকা-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া এই ভাইরাস বিরাট আতঙ্ক তৈরি করে জনমানসে।
অদেখা ভাইরাসে একের পর এক মৃত্যুর খবর আসতে থাকার মধ্যে সংক্রমণ রোধে কেউ আক্রান্ত হলে ওই বাড়ি অবরুদ্ধ করা হয়। আবার এলাকা ধরে ধরে অবরুদ্ধ করার এক পর্যায়ে সারা দেশে লকডাউন দেওয়া হয়, যা টানা দুই মাসের মতো কার্যকর থাকে।
এই সময়ে আক্রান্তদের পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স ও সেচ্ছাসেবকরা সামাজিক হয়রানির শিকার হতে থাকেন। জনমনে তৈরি হয় ভুল বোঝাবুঝি, যা এখন অনেকটাই কেটে গেছে।
মার্চে সংক্রমণ শুরুর দিকে সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে সুরক্ষা সামগ্রী, ত্রাণ ও ওষুধ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন কাউন্সিলর খোরশেদ। এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে পরিস্থিতির কারণে তিনি বাধ্য হন মৃতদেহ সৎকারের কাজে যুক্ত হতে। এরপর এই কয় মাসে কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া বা এই রোগের লক্ষণ নিয়ে মারা যাওয়া দেড়শ মানুষকে চিতায় দাহ বা কবরে রেখেছেন তিনি।
মৃতদেহ কবরে নামাচ্ছেন কাউন্সিলর খোরশেদ ও তার সঙ্গীরা
মহামারী শুরুর দিকের একটি ঘটনা তুলে ধরে খোরশেদ বলেন, “দুই মেয়ের জনক একজনকে যখন দাফন করি তখন তার মুখের দিকে তাকানোর সময় আমার ছিল না। স্ত্রী আর দুই মেয়ে ছাড়া তার কোনো স্বজনের দেখা পাইনি সেদিন। পরে জানতে পারি সে আমার ছোটবেলার খেলার সাথী। আমরা এক সাথে বড় হয়েছিলাম। পরে সে চলে গেছে শহরের আরেক প্রান্তে।”
এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত নিজের ১৫ জনের সেচ্ছাসেবক দল নিয়ে ১৪২ জনের সৎকার করেছেন খোরশেদ। এর মধ্যে ২৫ জন ছিল ভিন্ন ধর্মের অনুসারী। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে ধর্মের পরিচয়ের বাধাকে বিবেচনায় নেওয়া যায়নি তখন।
“একদিন একজন হিন্দু ভদ্রলোক ফোন করে বলেন, আমার দুলাভাইয়ের অবস্থা তো খারাপ, আপনারা একটু আসেন। গিয়ে দেখি তৃতীয় তলা আর চতুর্থ তলার মাঝামাঝি সিঁড়িতে লাশ পড়ে আছে। প্রয়াতের স্ত্রী, মা ও এক কন্যা রয়েছেন চারতলার বাসায়। ভবনের লোকজন তাদের কাঁদতেও দিচ্ছিল না। কারণ খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবেশীদের চাপে পড়ে যাবে।
“নিহতের স্ত্রী বললেন, তার যখন শ্বাসকষ্ট শুরু হইছে আত্মীয়-স্বজন সবাইকে অনুরোধ করেছি, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে ৯৯৯ এ ফোন করে একটা অ্যাম্বুলেন্স আনাইছি। কিন্তু কেউ যে ধরে অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত নিয়ে যাবে এমন লোক পাইনি। আমি আর শাশুড়ি ধরে নামানোর সময় সিঁড়িতেই তার প্রাণ যায়।”
খোরশেদ বলেন, তখন পরিস্থিতি ছিল ভয়ঙ্কর। কেউই তার সৎকারে এগিয়ে এলো না। ঠিকমতো আচার মেনে করা হচ্ছে কি না সেই নির্দেশনা দেওয়ার জন্যও এলো না।
“তার স্ত্রী বলল, আপনারা মানুষ হিসাবে আমার স্বামীর একটা গতি করে দেবেন এটাই আপনাদের কাছে আমার দাবি। আমরা সবাই সেদিন রোজাদার ছিলাম, দলের প্রত্যেকে মুসলিম ছিলাম। দ্বিতীয় রোজার ঘটনা। আমরা সেদিন ধর্মের দেওয়াল তুলতে চাইনি। নিজেরাই চিতায় দাহ করেছি।”
কাউন্সিলর খোরশেদ ও তার সঙ্গীরা
আরেকটি ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, “রোজার ঈদের পরের দিনের ঘটনা। আরেকজন হিন্দু ভদ্রলোককে পেয়েছিলাম যিনি করোনা পজিটিভ ছিলেন। তার কোনো সন্তান ছিল না। তার নাক কান ও মুখ দিয়ে অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ওই অবস্থায় আমরা পাইছি। আমাদের ফোন করে জানানো হল, উনি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন আর তার ডায়রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা যেন পারলে কিছু স্যালাইন বা অন্যান্য ওষুধের ব্যবস্থা করি। স্যালাইন নিয়ে গিয়ে দেখি তার নাক কান গলা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তার এক শ্যালকসহ ধরে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর শ্যালক লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। তার মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যায়। তাকেও আমরা সৎকার করি।”
আরেকজন হিন্দু ব্যক্তির পরিবারের ইচ্ছায় তার মুখাগ্নি করার কথা জানিয়ে খোরশেদ বলেন, “তার কোনো ছেলে নেই। তিন মেয়ে। মেয়েরা মুখাগ্নি করতে পারে না। মেয়ের অনুমতি নিয়ে আমি মুখাগ্নি করি। উনি আমার বাম হাত ধরছে, আমি ডান হাতে মুখাগ্নি করি।”
মৃতদেহ সৎকারে বান্দরবান থেকে ঢাকা আসেন শাহানা
কোভিড-১৯ মহামারীতে সার্বিক সেবা নিয়ে এগিয়ে আসা আরেক প্রতিষ্ঠান ঢাকার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৬০০ এর মতো মৃতদেহ দাফন করেছেন কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবীরা।
নারী-পুরুষ সেচ্ছাসেবীরা পৃথক দলে ভাগ হয়ে প্রয়োজন মতো দেশের বিভিন্ন স্থানে সেবা দিচ্ছেন তারা। তাদেরই একজন শরীফা শাহানা যিনি ঢাকায় করোনাভাইরাসে মৃতদের সৎকারের জন্য কর্মস্থল বান্দরবান থেকে চলে এসেছেন। বান্দরবানে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনেরই একটি স্কুলে শরীর চর্চা ও ভলিবলের কোচ হিসাবে কাজ করছেন শাহানা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকায় কোয়ান্টামের কর্মীরা করোনাভাইরাসে মৃতদের সৎকারে যুক্ত হয়েছে শুনে তিনিও আগ্রহী হন। স্কুল বন্ধ থাকায় চলে আসেন ঢাকায়।
“জুন মাসের ৫ তারিখ থেকে আমি যুক্ত হয়েছি। এখনও করোনা সন্দেহভাজনদের গোসল করানোর কাজটি করে যাচ্ছি। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, গোসল করানোর পর লাশ নিয়ে কবরে যেতে হয়েছে। কারণ যেসব স্বজনদের কাজটি করার কথা তারা কেউ ভয়ে এগিয়ে আসছিল না।”
রাজধানীর তালতলা কবরস্থানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজনকে দাফনের আগে জানাজা পড়া হচ্ছে; গত ১১ এপ্রিলের ছবি।
মুগদা হাসপাতালের একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর মারা গেলেন একজন নারী।
“উনার স্বামী পরিচয় দিয়ে একজন ভর্তি করে গিয়েছিলেন, কিন্তু ভর্তির পর আর খোঁজ নেননি। আমরা হসপিটালের রেজিস্ট্রার বই থেকে নম্বর নিয়ে ফোন দিলাম। একজন লোক ফোন ধরলেও তাকে চেনে না বলে দিলেন। এ রকম অনেকগুলো ঘটনার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছে।”
তিনি বলেন, “বাসাবাড়ির চতুর্থ তলা, পঞ্চম তলা এমনকি ষষ্ঠ তলা থেকে আমরা লাশ নামিয়েছি। স্বজনরা কেউ এগিয়ে আসেনি। নামানোর সময় কোনো পুরুষই হেল্প করেনি। উনারা শুধু বলে দিলেন যে, লাশ এই রুমে রয়েছে। এরপর লাপাত্তা। এই ব্যাপারগুলো সব সময় ঘটেনি। তবে একাধিকবার ঘটেছে। উনারা ভয় পাচ্ছিলেন। বার বার স্যানিটাইজার স্প্রে করছিল।”
নিজের সুরক্ষার বিষয়ে কী করেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদেরও সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। আমরা যতটুকু সম্ভব সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করছি। আমার মনে হয়নি যে, এসব করতে গিয়ে আমরা আক্রান্ত হব। পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ‘গুরুজির’ নির্দেশনা আসছিল। সেগুলো আমরা মেনে চলছি। ইয়োগা করছি, সকালে স্নানায়ন করছি, কালোজিরা-নিমপাতা ও রসুন খাচ্ছি, গরম মসলার পানি খাচ্ছি। আনারস, কাঁঠালসহ অন্যান্য মৌসুমী ফলগুলো খেতাম সেই সময়।”
রাজধানীর রামপুরার এক বাসিন্দা গত জুন থেকে কোয়ান্টামের হয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছেন। তার স্ত্রীও যুক্ত হয়েছেন এই কাজে। বেওয়ারিশ, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষের লাশের গোসল, দাফন হয়েছে তাদের হাত ধরে। তবে এ নিয়ে অন্যদের রোষানলে পড়ার ভয়ে পুরো ব্যাপারটাই গোপন রেখেছেন তারা।
ওই ব্যক্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজগুলো করছি। কোয়ান্টামের কোনো স্বেচ্ছাসেবী এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হননি। তবুও আমরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে চলেছি। কারণ এটা নিয়ে সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বাজে প্রতিক্রিয়া হতে পারে।”
শহীদুলের শক্তি ইবোলা মহামারীর অভিজ্ঞতা
মহামারীকালে দাফন সংক্রান্ত সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসা আরেক প্রতিষ্ঠান মারকাজুল ইসলামী। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হামজা শহীদুল ইসলাম আফ্রিকায় ২০১৫ সালে ছড়িয়ে পড়া ইবোলা মহামারী মোকাবেলায় স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে অংশ নিয়েছিলেন।
করোনাভাইরাসে মৃতদের গোসল ও দাফন নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর; একসঙ্গে ১০ জন প্রশিক্ষণ নিলেও টিকে ছিলেন শুধু আফ্রিকায় ইবোলা মহামারীতে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করা হামজা শহীদুল ইসলাম।
ইবোলা পরিস্থিতি সামালের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শহীদুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৫ সালে আফ্রিকায় ইবোলা হল। আমি তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় স্নাতক পড়ছিলাম। বিশ্বের ৭৭টা দেশের ছাত্ররা একত্রিত হয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ শুরু করেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা এবার নিজ দেশে আমাকে সাহস যুগিয়েছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ইসলামী ফাউন্ডেশনের কাছ দেশে কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মৃতদেহ দাফন শুরু করে মারকাজুল ইসলামী। ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে দাফন করেছে তারা।
শহীদুল বলেন, “আমাদের ১০ জনকে প্রথম স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রশিক্ষণ দেয়। কিন্তু ওই প্রশিক্ষণ শেষে আমি ছাড়া বাকি নয়জন অপারগতা প্রকাশ করে। একমাত্র টিকে থাকলাম আমি। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেওয়া শেষে ২৯ মার্চ আমরা প্রথম ডেডবডি নিয়ে কাজ শুরু করি। আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম। প্রথম বডি যখন ইকবাল রোডে আনতে যাই তখন আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট বলতে কিছুই ছিল না।
তিনি বলেন, “মাসখানেক মৃতদেহ হ্যান্ডল করার মধ্যেই আমাদের টিমের লোকজনের দুইবার করে করোনাভাইরাস টেস্ট করানো হল। দুইবারই সবার নেগেটিভ আসল। তখন আমাদের মধ্যে ভয়টা আরও কমে গেল। কারণ অসুস্থ ব্যক্তি থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে, কিন্তু মৃতদেহ থেকে ছড়াবে এমনটা আমাদের মনে হত না। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও একই ধরনের কথা বলা হল।”
করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা আশপাশের মানুষজন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ওই সময় আমরা সবার কাছে ছিলাম অনাকাঙ্ক্ষিত। জাস্ট কারও সামনে গেলে তারা অস্বস্তিতে ভুগত। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হল। লাশ দাফনে বাধা দেওয়া হয়েছে। আমরা ব্যাপারগুলো সামাল দিয়েই কাজটা চালিয়ে নিয়েছি।”