ক্যাটাগরি

বনের নিয়োগ-পদোন্নতিতে ‘ঘুষের তথ্য’ টিআইবির প্রতিবেদনে

টিআইবি বলছে, “সংশ্লিষ্ট
মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক ও ব্যক্তিগত সহকারী এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের
একাংশ” এই ঘুষ লেনদেনে জড়িত।

বুধবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ
সম্মেলনে ‘বন অধিদপ্তর: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে
বন অধিদপ্তরের ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের’ ক্ষেত্র উল্লেখ করে ‘বিধিবহির্ভূত’ লেনদেনের চিত্র
তুলে ধরেন টিআইবির ডেপুটি প্রোগ্রাম
ম্যানেজার মো. নেওয়াজুল মওলা।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে প্রধান বন সংরক্ষক
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী দাবি করেছেন, তার অধিদপ্তরে নিয়োগ বা বদলির কোনো ক্ষেত্রে কোনো
অনিয়ম বা দুর্নীতি ‘হয়নি’।

টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে নেওয়াজুল
মওলা বলেন, প্রধান বন সংরক্ষক হিসেবে পদোন্নতির জন্য এক কোটি থেকে তিন কোটি টাকা ‘বিধিবহির্ভূত’
লেনদেনের অভিযোগ তারা এ গবেষণা চালাতে গিয়ে পেয়েছেন।

এছাড়া বন সংরক্ষক হিসেবে
নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি
বা বদলির ক্ষেত্রে ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা, প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেতে এক
থেকে দেড় কোটি টাকা এবং সহকারী বন সংরক্ষক পদে বদলির ক্ষেত্রে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা
লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথা জানান তিনি।

টিআইবির প্রতিবেদন বলছে,
রেঞ্জ কর্মকর্তা, চেক স্টেশন ইনচার্জ, ফরেস্টার, বিট কর্মকর্তা এবং বন প্রহরী পদে বদলি
হতে প্রধান বন সংরক্ষকের দপ্তর, আঞ্চলিক ও বিভাগীয় বন কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের
একাংশকে ‘লাখ লাখ টাকা ঘুষ’ দিতে হয়।

রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে বদলির
ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা, চেক স্টেশন ইনচার্জ ও ফরেস্টার পদে বদলি ১০ থেকে ২৫
লাখ টাকা, বিট কর্মকর্তার বদলিতে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা এবং বন প্রহরী পদে বদলির ক্ষেত্রে
৫০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকার ‘ঘুষ’ লেনদেন হয় বলে টিআইবির ভাষ্য।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক
ইফতেখারুজ্জান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “প্রতিবেদেনে আমরা দেখলাম বন বিভাগে নিয়োগ, পদোন্নতি,
বদলির ক্ষেত্রে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান জর্জরিত অবস্থায় রয়েছে।”

বনভূমির সুরক্ষা এ অধিদপ্তরের
প্রধান দায়িত্ব হলেও তা পালনে তারা ‘সুষ্পষ্ট ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে’ মন্তব্য করে
প্রতিবেদনে বলা হয়, বনভূমির প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ২৪০ একর জমি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে
বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক
বলেন, “বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি বনভূমি জবরখলের ঘটনাও ঘটে, সেগুলো প্রতিরোধে বন অধিদপ্তরকে
কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। অনেক সময় বন অধিদপ্তর এড়িয়ে গেছে। কোনো কোনো বনভূমি
জবরদখল ও আত্মসাতের ক্ষেত্রে বন কর্মকর্তাদের যোজসাজশ রয়েছে।”

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আমরা
বিশেষ করে লক্ষ্য করেছি যে, বন উজার, বনভূমি বেদখল ও অবৈধভাবে বনভূমি বরাদ্দ কিংবা
ব্যবহার করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের একাংশের সম্পৃক্ততা ও যোগসাজশের
মাধ্যমে দুর্নীতিকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রক্ষকই বাস্তবে
ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে।”

বন অধিদপ্তর ক্ষমতার অপপ্রয়োগও
করছে মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “বনকেন্দ্রিক দুর্নীতি যে হচ্ছে,
এই দুর্নীতিতে এক শ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশ ও তাদের কর্মকাণ্ড বন সংরক্ষণে অন্যতম
প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্ত কারণে বন ও বনজ সম্পদের সুরক্ষাকারী হিসেবে
বন অধিদপ্তরের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।”

অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে
বন অধিদপ্তর ‘ব্যর্থতা দেখিয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “বনভূমি ও এর
পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে পরিবেশবিধ্বংসী কয়লা খনি
প্রকল্প এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা স্থাপনের বিষয়ে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বন অধিদপ্তর
যথাযথ ভূমিকা পালন করতে দেখিনি।”

বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে
টিআইবির প্রতিবেদনে। বনভূমি ব্যবহারের আগে অধিদপ্তরের অনুমতি নেওয়া, বন নির্ভর মানুষের
ভূমির অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া, সংরক্ষিত বনের জমিতে সামাজিক বনায়ন বন্ধ করা, সামাজিক
বনায়নের গাছ না কেটে উপকারভোগীদের মুনাফা দিয়ে বন সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে সেখানে।

এছাড়া বনভূমি নিয়ে সরকারি
কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বন অধিদপ্তরের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক করা, বনভূমির
এলাকায় কোনো স্থাপনা ও বিদ্যুৎ লাইন দেওয়াসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন
নেওয়া, বন আইন-১৯২৭ এর সংশোধন ও বিধিমালা প্রণয়ণ এবং প্রয়োজনীয় নতুন আইন করাসহ বিভিন্ন
সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ
অ্যান্ড কমিউনিকেশনস) শেখ মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রতিবেদনের
প্রথম অংশ তুলে ধরেন সংস্থার প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. রেজাউল করিম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯
সালের জানুয়ারি থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এ গবেষণার তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই
করা হয়েছে। বন বিভাগের ৬০টি কার্যালয়ের ১৩০ জন মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকারসহ বিষয়বস্তুর
সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত অন্যদের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ
করার কথা বলেছে টিআইবি।

প্রধান বন সংরক্ষক যা বলছেন

টিআইবির প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে
দুর্নীতি বা অনিয়মের কথা অস্বীকার করেন প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন,
“কয়েক বছর ধরে তো পদোন্নতিই নেই।”

আমীর হোসাইন বলেন, আইনগত কারণে ২০১৬
সালে অধিদপ্তরের নিয়োগবিধি বাতিল হয়ে যায়। ১০ গ্রেড থেকে ২০ গ্রেড পর্যন্ত কোনো নিয়োগ
হয়নি। ২০১২ সালে নিয়োগ পরীক্ষা হলেও পরে তা স্থগিত হয়ে যায়। তবে ২০১৯ সালে নতুন নিয়োগবিধি
সরকার অনুমোদন করলে পরে ৫১ জন ফরেস্ট অফিসার ও ২০ জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

“যেখানে কোনো পদোন্নতি বা নিয়োগ দেওয়া
সম্ভব হয়নি, সেখানে অনিয়ম-ঘুষ বাণিজ্যর মত অভিযোগ তোলা কতটা যৌক্তিক তা একটা প্রশ্ন
হয়ে থাকল।”

গত ২৫ মার্চ থেকে প্রধান বন সংরক্ষক
হিসেবে দায়িত্বে আছেন আমীর হোসাইন। তার পদায়নের ক্ষেত্রেও‘বিধিবহির্ভূত লেনদেনের’ অভিযোগ
এসেছে টিআইবির প্রতিবেদনে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রধান বন
সংরক্ষক বলেন, “আমাকে নিয়োগ দিয়েছে মন্ত্রণালয়, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় বলবে। এছাড়া প্রথম
শ্রেণিসহ ওপরের পদে পদোন্নতি মন্ত্রণালয় থেকে হয়। সেটাও মন্ত্রণালয় বলতে পারবে যে
কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা।”

বন বিভাগের জমি বেদখল হওয়ার বিষয়ে তিনি
বলেন, “যিনিই আমাদের জমি বেদখল করেছেন, সেই প্রতিটি ঘটনায় আমরা মামলা করেছি। এ বিষয়ে
সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনে তালিকা পাঠিয়েছি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।”

অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার ক্ষমতা আইনে
বন অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়নি জানিয়ে আমীর হোসাইন বলেন, “আমরা বাধা দিতে পারি। দখলে বাধা
দেওয়ার কারণে সম্প্রতি কক্সবাজারে আমাদের একজন কর্মী মারা গেছেন। একই কারণে সাভারেও
আমাদের ছয়জন আহত হয়ে মেডিকেলে ভর্তি হতে হয়েছেন। আমাদের আইন অনুযায়ী বাধা দিচ্ছি।”

টিআইবির প্রতিবেদনে বন অধিদপ্তরের কোনো
কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা
নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।