ক্যাটাগরি

মহামারীতে বিশ্বজুড়ে নিরানন্দ, বর্ণহীন বর্ষবরণ

তবুও মহামারীতে নানা দুর্ভোগের বছর ২০২০-কে বিদায় জানাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যেই স্বল্প পরিসরে, অনেকটাই নীরবে-নিভৃতে হলেও বিশ্বজুড়ে মানুষ স্বাগত জানাচ্ছে ২০২১ সালকে।

বিশ্বের বহু দেশই করোনাভাইরাসের নতুন প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে। তাই বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহর-নগরীগুলোতে নববর্ষ উদযাপনের এই সময়ে জারি রয়েছে কঠোর সব বিধিনিষেধ।

সিডনি থেকে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত বিভিন্ন নগরীতে বাতিল করা হয়েছে আতশবাজি প্রদর্শণী, লোক সমাগম। করোনাভাইরাসের অতি-সংক্রামক নতুন ধরননিয়ে উদ্বেগে থাকা ইউরোপে নববর্ষ উদ্‌যাপনে নেই কোনও উদ্দীপনা।

নতুন বছর বরণের কোনও পার্টি যাতে না হয় সেজন্য ফ্রান্স মোতায়েন করেছে ১ লাখ পুলিশ, জারি করেছে রাত্রিকালীন কারফিউ।

করোনাভাইরাস একটি বছরেই বিশ্বজুড়ে কেড়ে নিয়েছে ১৮ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ। ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৮ কোটি ১০ লাখেরও বেশি মানুষের।

মৃত্যু-আক্রান্তের এই ধারা এখনও চলছে। তাই এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের দেশগুলো মানুষকে নিরাপদ রাখা এবং কঠিন একটা বছর পাড়ি দেওয়ার পর তাদেরকে বিধিনিষেধে কিছুটা ছাড় দেওয়া- দু’য়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে।

আর তা করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মতো করোনাভাইরাস সংক্রমণ অপেক্ষাকৃত কম থাকা দেশগুলোর স্থানীয় সরকারও বর্ষবরণের এই সময়ে উৎসব উদযাপনের পরিকল্পনা করে আবার তা থেকে পিছিয়ে আসছে।

অনেক দেশেই কড়া লকডাউন, কারফিউ জারি রেখে লোকজনকে বাড়িতে থেকেই আপনজনদের নিয়ে বর্ষবরণ উদযাপনের আহ্বান জানানো হয়েছে।

এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে বর্ষবরণ:

বিশ্বে প্রথম নতুন বছরকে স্বাগত জানানো দেশগুলোর মধ্যে আছে অস্ট্রেলিয়া। সেখানে প্রতিবছরই সিডনি নগরীর বিখ্যাত অপেরা হাউসে কাউন্টডাউন করে যে আতশবাজির আয়োজন করা হয় তা দেখতে প্রচুর মানুষ ভিড় জমায়।

কিন্তু এ বছর সিডনিতে নববর্ষ উদযাপনে আতশবাজি হলেও তা দেখতে বড় ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।মানুষজনকে আতশবাজি দেখতে বলা হয়েছে ঘরে বসে। সিডনি হারবার ব্রিজে আয়োজন করা হয়েছে মাত্র ৭ মিনিটের আতশবাজি প্রদর্শনী।

নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নববর্ষের রাতে সিডনির শহরতলীতে লোকসমাগম নিষিদ্ধ করাসহ বাসার বাইরের জমায়েত ৫০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন।

নববর্ষের উৎসবে গোটা রাজ্য জুড়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে কোনও অনুষ্ঠান করার পক্ষপাতি নন তিনি।

চীন: রাজধানী বেইজিংয়ে নববর্ষের লাইটশো’ বাতিল করা হয়েছে। দেশজুড়ে বিভিন্ন নগরীতে নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হয়েছে। বেইজিংয়ের পর্যটন এলাকা ইয়ংহে লামা টেম্পলেও দর্শণার্থীর সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকেই। অনেক চীনা পর্যটকই ঘরে থাকছেন।

জাপান: মহামারী আর তুষারপাতের দ্বৈত সংকটের কারণে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা এবার লোকজনকে নতুন বছর নীরবেই পালন করা এবং প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

জাপানের ‘ইম্পেরিয়াল হাউজহোল্ড এজেন্সি’ ২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নববর্ষের উৎসব বাতিল করেছে। ওই উৎসবে শুভাকাঙ্খীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করার কথা ছিল সম্রাট নারুহিতো ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের।

ভারত: নতুন বছর বরণের উৎসবে বড় ধরনের জমায়েত ঠেকাতে রাজধানী দিল্লি এবং অন্যান্য বেশ কিছু নগরীতে রাত্রিকালীন কারফিউসহ অন্যান্য বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

নয়াদিল্লিতে জনসমাগম এলাকাগুলোতে ৫ জনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর মুম্বাই এবং ব্যাঙ্গালুরুতে জমায়েত সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে ৪ জনে।তবে গোয়ায় এমন কোনও বিধিনিষেধ নেই। গোয়ায় লোকজন গত সপ্তাহ থেকেই ভিড় জমাতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে গণমাধ্যম।

নিউ জিল্যান্ড: কড়া লকডাউন এবং সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে দেশটি করোনাভাইরাস সংক্রমণ একরকম দূর করতে সক্ষম হয়েছে। তাই দেশটির অকল্যান্ডে বরাবরের মতোই এবারও হচ্ছে আতশবাজি।

অকল্যান্ডের মেয়রের কথায়, নিউ জিল্যান্ডবাসীদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় দূর হয়েছে কোভিড-১৯। আর তাই নিউ জিল্যান্ড অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক সময়ের মতোই জীবনকে উপভোগ করার সৌভাগ্যজনক অবস্থানে আসতে পেরেছে। আর তাই বর্ষবরণের উৎসব উদযাপন তো চলতেই পারে।

সিঙ্গাপুর: মেরিনা বে তে এবার নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে হচ্ছে না কোনও আতশবাজি। ২০০৫ সাল থেকে সেখানে চলে আসা আতশবাজিতে বর্ষবরণের ধারা এবারই প্রথম ভঙ্গ হচ্ছে। এর পরিবর্তে বরং সিঙ্গাপুরজুড়ে বিভিন্ন স্থানে আতশবাজির আয়োজন করা হয়েছে।

হংকং: ভিক্টোরিয়া হারবারে আতশবাজির উৎসব বাতিল করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে চান্দ্র বছরের প্যারেডও বাতিল হয়েছে বলে জানিয়েছে ‘দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ পত্রিকা।

দক্ষিণ কোরিয়া: নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয় দেখতে প্রতিবছর মানুষ যে জায়গাটিতে জড়ো হয়, সেই পূর্ব-উপকূলীয় গাংগুয়েং সৈকত এবার বন্ধ করে দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার। তাছাড়া, সিউলেও নতুন বছরের শুরুতে ঘণ্টাধ্বনি বাজানোর উৎসবও এবার ১৯৫৩ সালের পর প্রথম বাতিল করেছে দেশটি।

ভিয়েতনাম: দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যু অনেক কম হওয়ায় নতুন বছর উদযাপনের ক্ষেত্রে বাড়তি কোনও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়নি। জনসমাগম এলাকাগুলোতে কেবল মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন বছরকে বরণ করতে দেশটির বড় বড় নগরীতে আতশবাজি প্রদর্শনী এবং পার্টির ক্ষেত্রে আরোপ করা হয়নি কোনও বিধিনিষেধ।

থাইল্যান্ড: এ দেশটিও নববর্ষ উদযাপনে বাড়তি কোনও কড়াকড়ি আরোপ করেনি। তবে কর্তৃপক্ষ লোকজনকে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে বলেছে এবং বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে।

ইউরোপের দেশগুলোতে বর্ষবরণ:

ফ্রান্সের শহরগুলোতে বৃহস্পতিবারই কারফিউয়ের মধ্যে কড়া নিরাপত্তা প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজধানী প্যারিসে সন্ধ্যা থেকেই বন্ধ করা হয়েছে মেট্রো রেল চলাচল। নববর্ষের রাতে যাতে কেউ রাস্তায় না নেমে আসে, সে ব্যাপারে প্যারিসের অধিবাসীদের সতর্ক করা হয়েছে। ফ্রান্সে লকডাউনের মধ্যে নতুন বছরেও বন্ধ থাকবে সব বার, রেস্তোঁরাসহ জনপ্রিয় সব স্থানগুলো।

ইংল্যান্ড: করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক নতুন ধরন নিয়ে বিপদে পড়া যুক্তরাজ্যে কড়া বিধিনিষেধে মানুষ ঘরে থাকতেই বাধ্য হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মানুষকে সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।

লন্ডনে টেমস নদীর ধারে নতুন বছর বরণে আতশবাজির উৎসব বাতিল করা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া মানুষের বাইরে না যাওয়া এমনকী অন্য পরিবারের কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার ব্যাপারেও লোকজনকে সতর্ক করা হয়েছে।

আয়ারল্যান্ড:  বৃহস্পতিবার আয়ারল্যান্ডে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে মানুষে মানুষে কোনওরকম দেখা-সাক্ষাৎ, তিন মাইলের বেশি ভ্রমণেও আরোপ করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

জার্মানি: দেশজুড়ে নববর্ষ উদ্‌যাপনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নববর্ষ উদ্‌যাপনে ছোট-বড় সমাবেশ, আতশবাজি বিক্রি এবং এর ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাজধানী বার্লিনে নিরাপত্তা রক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ।

নেদারল্যান্ডস: এ দেশটিও রয়েছে লকডাউনে। এই লকডাউন চলবে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। নতুন বছর বরণের কাউন্টডাউন আমস্টারডাম স্টেডিয়ামে রুদ্ধদ্বার পরিবেশেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে নেদারল্যান্ডস।

তুরস্ক: নববর্ষকে স্বাগত জানানোর আগমুহূর্ত থেকেই দেশটি চারদিনব্যাপী লকডাউন শুরু করেছে। ওদিকে, ফ্রান্সের মতো ইতালিও বর্ষবরণের রাতে লোকসমাগম ঠেকাতে কারফিউ জারি করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র:

যুক্তরাষ্ট্রেও এবার বহু রাজ্য এবং নগরীতে নতুন বছর বরণের এই সময়ে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে নতুন বছর বরণের কাউন্টডাউনের সময় মধ্যরাতে ফাঁকা পরিবেশেই অর্ধনমিত করা হচ্ছে আলোঝলমলে টাইমস স্কয়ার বল। প্রতিবারের মতো এবার সেখানে নেই কোনও লোকসমাগম।

সান ফ্রান্সিসকো, লাস ভেগাসে বাতিল করা হয়েছে আতশবাজির উৎসব।