ক্যাটাগরি

মহামারীর বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৮৮ জন: আসক

মানবাধিকার
সংস্থাটি বলেছে, গত বছর ১৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। নারী
নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণ ও পারিবারিক নির্যাতন উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।

বিদায়ী
বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে আসক। এবার সংবাদ
সম্মেলনটি ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়।

লিখিত
বক্তব্যে আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, “২০২০ সালে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধ/গুলিবিনিময়ে নিহত হয়েছেন ১৮৮ জন।
এর মধ্যে চলমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানে নিহত হন ১১২ জন।”

গণমাধ্যমে
প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান ও পর্যালোচনা
করে এই তথ্য সন্নিবেশিত করেছে আসক।

সংবাদ
সম্মেলনের আসকের সহকারী সমন্বয়কারী অনির্বাণ সাহা বলেন, “করোনাকালেও অব্যাহত ছিল
রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা।”

বিচারবহির্ভূত
হত্যাকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট তথ্য হিসেবে ওমানপ্রবাসী মো. জাফরের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হওয়ার
ঘটনাটি তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

আসক
জানায়, ২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে (গ্রেপ্তারের পর) নিহত হন
১১ জন। এছাড়া গ্রেপ্তারের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে মারা যান ৫ জন এবং
গুলিতে নিহত হন ৮ জন। অন্যদিকে এ বছর দেশের কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন
কারণে মারা গেছেন ৭৫ জন।

মানবাধিকার
সংস্থাটি জানায়, ২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের
শিকার হন ৬ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, এখনও নিখোঁজ
রয়েছেন ২ জন।

বছরটিতে
ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ৪২ বাংলাদেশির নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে
আসক। এছাড়া এই বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনে আরও সাতজন বাংলাদেশি নিহত হন বলেও জানানো
হয়েছে।

নারী
অধিকার-পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, করোনাভাইরাস
মহামারীর সময়েও নারীর প্রতি সহিংসতা চলতে থাকে। এই সময়কালে নারী নির্যাতন, বিশেষ
করে ধর্ষণের ঘটনা ও ভয়াবহতা বেড়েছে।

আসক
জানায়, এই বছর সারাদেশে ১ হাজার ৬২৭ নারী ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। এর
মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন
১৪ জন।

২০১৯
সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ১ হাজার ৪১৩ নারী এবং ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২।

নতুন
আইনে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলেও এই অপরাধ কমবে না মন্তব্য করে আসকের জ্যেষ্ঠ
সমন্বয়কারী ফয়জুল কবির বলেন, ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান
রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন কার্যকরের পর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬০টি
ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

আসক
জানায়, এই বছর ২০১ জন নারী নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ১০৬ পুরুষ।
উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ নারী। এছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে
গিয়ে ৩ নারী ও ১১ পুরুষসহ ১৪ জন খুন হয়েছেন।

সংবাদ
সম্মেলনে বলা হয়, বছরটিতে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। এবার ৫৫৪ নারী
পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ৩৬৭ জন
এবং আত্মহত্যা করেন ৯০ জন।

২০১৯
সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৪২৩ নারী।

আসকের
তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী বছর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১৮ নারী। এর
মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৮৯ নারী এবং ১৮ নারী আত্মহত্যা
করেন।

সালিশের
মাধ্যমে নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানায় সংস্থাটি।

সালিশে
আট নারী নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে সালিশে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২ নারী
এবং নির্যাতন পরবর্তী সময়ে এক নারী আত্মহত্যা করেন।

গৃহকর্মী
নির্যাতন ও অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা সম্পর্কে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে
৪৫ নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর তিন
নারী মারা যান। অন্যদিকে এই বছরে অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হন ২৭ নারী।

প্রতিবেদনে
বলা হয়, ২০২০ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ
চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয়
৫৮৯টি শিশু।

২০১৯
সালে এসব ঘটনায় নিহত শিশুর সংখ্যা ছিল ৪৮৮।

এছাড়া
২০২০ সালে অন্যান্যভাবে এক হাজার ৭১৮ শিশু নির্যাতনের শিকার হয় জানিয়ে বলা হয়, এর
মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় এক হাজার ১৮টি শিশু, ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়
২৭৯টি শিশু। বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৫২ ছেলে শিশু, বলাৎকারের পর তিন শিশুর মৃত্যু হয়।

অনলাইনে
শিশুদর যৌন হয়রানির পাশাপাশি সরকারি শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে অনিয়ম,
অব্যবস্থাপনা ও নির্যাতনের ঘটনার কথাও্ এসেছে প্রতিবেদনে।

আসকের
পরিসংখ্যান ২০২০ সালে ৩৫ জন গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন।

করোনাভাইরাস
মহামারীর মধ্যে দেশে মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করাসহ দমন-পীড়ন বেড়েছে বলে মনে করে
আসক।

সংস্থাটির
হিসেবে ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৩০টি মামলায় ২৭১ জনকে আসামি করা হয়।
এছাড়া উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গী গোষ্ঠী কর্তৃক ভিন্নমতের প্রতি হুমকি, হামলা ও ভাস্কর্য
ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

সাংবাদিক
নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি
কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের
নেতা-কর্মীদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, হামলা, মামলা, হুমকি ও হয়রানিসহ
বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৪৭ সাংবাদিক। এর মধ্যে ২ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের
শিকার হন।

বছরটিতে
সভা-সমাবেশে বাধাদান, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার কথাও উঠে এসেছে
আসকের প্রতিবেদনে।

এতে
বলা হয়েছে, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ৬৭টি প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির
ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ১১টি বাড়িঘর ও তিনটি
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ সব ঘটনায় হিন্দু ও বৌদ্ধ
সম্প্রদায়ের ৭১ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের মসজিদ ও বাড়িঘরে
হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

স্বাস্থ্যের
অধিকার নিয়ে আসকের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে
স্বাস্থ্যখাতে বিপর্যয় নেমে আসে। সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত’
সন্দেহে রোগীদের বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পাওয়া এবং আইসিইউ সাপোর্টের
অভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অনেকের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে।

কোভিড-১৯
আক্রান্ত হয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২৭ জন চিকিৎসক মারা গেছেন বলে আসক জানায়। এছাড়া দায়িত্ব
পালন করতে গিয়ে বহু পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য আক্রান্ত হন, তাদের মধ্যে ৮২ জন মারা যান।

সংবাদ
সম্মেলনে মানবাধিকার সুরক্ষায় ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন আসকের নির্বাহী পরিচালক
গোলাম মনোয়ার কামাল।

সুপারিশগুলোর
মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে
তা দ্রুততার সাথে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা, গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের
অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, গণমাধ্যম ও
নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অংশীজনদের
মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা।

এছাড়া
নারীর প্রতি সব প্রকার বৈষম্য আইন নিরসন, নারীর ওপর সহিংসতা বন্ধে কার্যকর
সচেতনতামূলক ও প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি জোরদার করা, শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম
ব্যক্তি, আদিবাসী, দলিত, তৃতীয় লিঙ্গ, অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও চা বাগানে
কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে সুপারিশ করেছে
আসক।
অন্যদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, আইন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও
নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর করা এবং এসব প্রতিষ্ঠানে অবসরপ্রাপ্ত আমলা নিয়োগ বন্ধ
করা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে উত্থাপিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে
কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, নাগরিকের জন্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং
পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

আসকের
জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামীর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তরপর্বে
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন আসকের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব মো. নূর
খান এবং নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামাল।