ক্যাটাগরি

পিলখানা হত্যা মামলা: ৯ আসামির ১ আপিলেই ব্যয় ‘১৫ লাখ টাকা’

এই ব্যয় কমাতে পেপারবুক মওকুফ চেয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ
মাহমুদ হোসেনের কাছে আবেদন করেছেন সংশ্লিষ্ট ‘অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড’ মো. তৌফিক হুসাইন।     

সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্ট বিধি অনুযায়ী আদালতে কোনো পক্ষের
আবেদন করার জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত আইনজীবীকে ‘অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড’ বলা হয়।

সুপ্রিম কোর্ট বিধি অনুযায়ী, হাই কোর্টের রায়ের প্রত্যায়িত
অনুলিপি সংগ্রহ করার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল দায়ের করতে হয়। সে হিসাবে আগামী সপ্তাহেই
শেষ হতে যাচ্ছে আপিল করার সময়সীমা।

কিন্তু এখন অবধি হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের
হয়েছে মোটে একটি। উচ্চ ব্যয়ের কারণেই আসামিদের পক্ষে আপিল হচ্ছে না বলে আইনজীবীদের
অভিমত।

মঙ্গলবার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নয় আসামির পক্ষে আপিল বিভাগের
সংশ্লিষ্ট শাখায় একমাত্র আপিলটি দায়ের করা হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নয় আসামি হলেন- সিপাহি কামাল মোল্লা,
আবদুল মোহিত, বজলুর রশীদ, মো. মনিরুজ্জামান, হাবিলদার ইউসুফ আলী, এ টি এম আনিসুজ্জামান,
সুবেদার মো. শহিদুর রহমান, নায়েক সুবেদার ফজলুল করিম ও নায়েক আবু সাঈদ আলম।

এই নয় আসামির আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন, “মঙ্গলবার আমরা আপিল দাখিল করেছি। হাই কোর্ট তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
আপিলে খালাস চাওয়া হয়েছে।”

হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের এটাই প্রথম আপিল জানিয়ে
এ আইনজীবী বলেন, “এই আপিলটি ৫৫ হাজার ৬২৩ পৃষ্ঠার। প্রতিটা আপিলেই এই পরিমাণ কাগজ লাগবে।
৪০০ পৃষ্ঠার একেকটা বইয়ে মোট ১৪০টা ভলিউম হয়েছে। প্রতিটা ভলিউমের ১৪ সেট আপিল জমা দিতে
হয়। সে হিসাবে ১ হাজার ৯৬০টা বই জমা দিতে হয়েছে। জমা দেওয়ার পর আপিলটি গ্রহণ করা হয়েছে।”

এতে কত টাকা খরচ হয়েছে- জানতে চাইলে আমিনুল বলেন, “রায়ের
প্রত্যায়িত অনুলিপি সংগ্রহ করতে আড়াই লাখ টাকার উপরে খরচ হয়েছে। আর পেপারবুক তৈরিতে
খরচ হয়েছে ১২ লক্ষ টাকার উপরে। সব মিলিয়ে আপিল দায়ের পর্যন্ত প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচ
হয়েছে।”

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

উচ্চ ব্যয়ের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটা অনেকের পক্ষেই
সম্ভব না। যে কারণে মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে একটা আবেদন করেছি। আমাদের অ্যাডভোকট
অন রেকর্ড মো. তৌফিক হুসাইন আবেদনটা করেছেন।”

আবেদনে কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য পেপারবুক
মওকুফ চেয়ে শুধু আবেদন করে আপিল দায়েরের সুযোগ চাওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

“যেহেতু আমাদের এক নম্বর আপিলের পেপারবুকেই সব জমা দেওয়া
হয়েছে। প্রতিটা আপিলেই তো একই জিনিস যাবে। এর খরচ বহন করা আপিলকারীদের পক্ষে সম্ভব
না। তাছাড়া এই বিশাল আপিল হ্যান্ডলিং করাও বিচারপতি মহোদয়দের পক্ষে সম্ভব না।”

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের একাদশ বার্ষিকীতে এ মামলার চূড়ান্ত
নিষ্পত্তিতে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও করেছিলেন।

তিনি তখন বলেছিলেন “এখন এমন একটা অবস্থার তৈরি হয়েছে আমার
মনে হয় একটা ডেডলক সৃষ্টি হয়ে যাবে।”

এ মামলায় হাই কোর্টের রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি সংগ্রহের
খরচ,হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের পেপারবুক তৈরি, আদালতে সেই পেপারবুক রাখার স্থান,
চূড়ান্ত বিচারের সময়সহ বিচারিক প্রক্রিয়ার নানাদিক নিয়েই মূলত তিনি এ আশঙ্কা প্রকাশ
করেছিলেন।

পিলখানা হত্যা: মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে অচলাবস্থার শঙ্কা
 

এক যুগ আগে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে বিদ্রোহের মধ্যে পিলখানায়
অর্ধ শতাধিক সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের মামলার উচ্চ আদালতের ২৯ হাজার পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ
রায় রায় প্রকাশ পায় ২০২০ সালের গত ৮ জানুয়ারি।

সুপ্রিম কোর্ট রুলস অনুযায়ী হাই কোর্টের রায়ের প্রত্যায়িত
অনুলিপি সংগ্রহ করার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল দায়ের করতে হয়।

আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, সুপ্রিম কোর্ট রুলস অনুযায়ী
রায়ের অনুলিপি গ্রহণ করার দিন থেকে এক মাস সময়ের মধ্যে আপিল দায়ের করতে হয়। সে হিসাবে
আগামী ১৩ জানুয়ারি আপিল দায়েরের সময় শেষ হচ্ছে।

“এই সময়সীমার মধ্যে প্রত্যেকের পক্ষে আপিল দায়ের করা সম্ভব
না। এখন মাননীয় প্রধান বিচারপতি যদি পেপারবুক থেকে অব্যাহতি দেন, তাহলে আমাদের কাছে
যারা আসবেন আগামী রোববার-সোমবারের মধ্যে তাদের আপিল দায়ের করতে পারব।”

প্রধান বিচারপতি অনুমোদন না দিলে কী হবে- এ প্রশ্নে আসামি
পক্ষের এই আইনজীবী বলেন, “অনুমতি না পেলে কী করব, বুঝতে পারছি না। পাওয়া গেলে ফাইল
করতে পারব। রাষ্ট্রপক্ষ কিন্তু প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে অব্যাহতি চেয়ে পেপারবুক ছাড়াই
কতগুলো আপিলগুলো দায়ের করেছেন। আমরাও একই প্রক্রিয়ায় চাচ্ছি।”

আপিল হওয়ার পর শুনানি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অ্যাডভোকেট
আমিনুল।

“আপিল শুনানি কী প্রক্রিয়ায় হবে, তা এখননি বলা মুশকিল।
মাননীয় প্রধান বিচারপতির একক সিদ্ধান্তের উপরই তা নির্ভর করবে। একটু অসিুবিধা তো হবেই।
হাই কোর্টে টানা তিন বছর শুনানি হয়েছে। আপিল বিভাগে তো কোর্ট আওয়ারও (কর্মঘণ্টা) কম,
সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই সময় বেশি লাগার কথা।”

ভার্চুয়াল কোর্টে এই আপিল শুনানি সম্ভব নয় বলে মনে করেন
তিনি।

এদিকে এ মামলায় হাই কোর্টের রায়ে যারা খালাস পেয়েছেন এবং
মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরিবর্তে যাদের যাবজ্জীবন হয়েছে, তেমন ৮৩ আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড
চেয়ে লিভটু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

গত ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব লিভ টু আপিল দায়র করা হয়েছে
বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। হাই কোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া ৭৫ জন
এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যারা যাবজ্জীবন পাওয়া ৮ জনের শাস্তি বাড়াতে ওই আবেদন হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে
বলেন, “৮৩ আসামির ব্যাপারে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আমরা ২০টি লিভ টু আপিল করেছি।
এতে আমাদের খরচ হয়েছে ২৭ লাখ টাকা।”

পিলখানা হত্যা: ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন
 

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী, কারণ খুঁজতে পরামর্শ হাই কোর্টের

পিলখানা হত্যা: ১৫২ আসামির ফাঁসির রায়

বিদ্রোহের অপরাধে দণ্ডিত হন ৬ হাজার জওয়ান
 

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিডিআরে
বিদ্রোহ দেখা দেয়। সে বিদ্রোহে সে বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বাহিনীর সদর
দপ্তরে বিদ্রোহী জওয়ানদের হাতে মারা যান ৫৭ সেনা কর্মকর্তা।

রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহে বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ
হারান। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে জওয়ানদের বিদ্রোহ।

৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে।
সেখানে ছয় হাজার জওয়ানের কারাদণ্ড হয়।

রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর
নাম বদলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হয়।

বিদ্রোহের বিচারের পর পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার
শুরু হয় সাধারণ আদালতে।

এই ছবি বিদ্রোহ শুরু দিনের; ফটকের উপরে সশস্ত্র জওয়ানরা

এই ছবি বিদ্রোহ শুরু দিনের; ফটকের উপরে সশস্ত্র জওয়ানরা

ঢাকার জজ আদালত ২০১৩ সালে রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং
১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড
দেয়।

বিদ্রোহের ঘটনা যেমন পুরো বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল, এক মামলায়
এত আসামির সর্বোচ্চ সাজার আদেশও ছিল নজিরবিহীন।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করতে হাই কোর্টের অনুমোদনের আবেদন) হাই কোর্টে আসে।

দণ্ডিত আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানি করে তিন বিচারপতির
সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে হাই কোর্ট। ১৮৫ জনকে
হাই কোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়, তিন থেকে ১০ বছরের সাজা দেয় ২২৮ জনকে।

সব মিলিয়ে হাই কোর্টের রায়ে অভিযোগ থেকে খালাস পায় মোট
২৮৮ আসামি। অভিযুক্ত ৮৪৬ জন আসামির মধ্যে বাকি ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

রায় ঘোষণার দুই বছরের বেশি সময় পর গত বছর ৮ জানুয়ারি ২৯
হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।

এর মধ্যে ১১ হাজার ৪০৭ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন বিচারপতি মো.
শওকত হোসেন।১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী। আর মো.
নজরুল ইসলাম তালুকদার লিখেছেন ১ হাজার ১০০ পুষ্ঠার রায়।

তবে হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চের বিচারকরা ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডের
অনুমোদন, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন ও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড ও সাজা বহালের ক্ষেত্রে
একমত হয়েই রায় দেন।