ক্যাটাগরি

এক যুগে কী করেছি, মূল্যায়নের ভার আপনাদের: প্রধানমন্ত্রী

সরকারের বর্তমান মেয়াদের দুই বছর পূর্তিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির
উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বাংলাদেশকে ‘আরও বহুদূর’ এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়ার পর টানা
তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে
টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জনগণের সরকার হিসেবে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা
আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলেই আমি মনে করি। গত একযুগে আমরা জনগণের জন্য কী করেছি,
তা মূল্যায়নের ভার আপনাদের।”

মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ‘ভীষণভাবে প্রভাবিত করে’ সে রকম কয়েকটি খাতের
উন্নয়নের চিত্র শেখ হাসিনা তার ভাষণে তুলে ধরেন।

জ্বালানি

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির
কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “কী দুঃসহ পরিস্থিতি ছিল সে সময়। বিদ্যুৎ কখন আসবে
আর কখন যাবে তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বল্প,
মধ্যম এবং দীর্ঘ-মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে আজ বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন
করেছি।”

তিনি জানান, ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ
জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার
৪২১ মেগাওয়াটে।

বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ২০০৫-০৬ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৯৯
শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পায়রাতে ইতোমধ্যে ১ হাজার
৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী,
মহেশখালী এবং মাতারবাড়িতে আরও মোট ৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ
কাজ চলছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শতভাগ মানুষের
ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। সব ঘর আলোকিত হবে।”

২০০৯ সালে জাতীয় গ্রিডে ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হত,
এখন তা ২ হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে বলে ভাষণে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন,
গ্যাসের অব্যাহত চাহিদা মেটাতে ২০১৮ সাল থেকে তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে।

খাদ্য

প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ং-সম্পূর্ণ। ২০১৯-২০
অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন।
বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ থেকে তৃতীয় স্থান উন্নীত হয়েছে। অব্যাহত নীতি সহায়তা
ও প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এই ‘বিপ্লব’ সাধিত হয়েছে।

শুধু ২০১৯-২০ অর্থবছরেই কৃষিখাতে ৭ হাজার ১৮৮ কোটি চাকার বেশি ভর্তুকি
দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ং-সম্পূর্ণ
হয়ে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয়
এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।

পল্লী উন্নয়ন

শেখ হাসিনা বলেন, দেশের গ্রামগুলো আগের সরকারগুলোর উন্নয়ন ভাবনার ‘বাইরেই’
থেকে গেছে সবসময়। আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত
করে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা
সম্প্রসারণের অঙ্গীকার করে।

এখন ‘দেশের প্রায় সব গ্রামে’ পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন,
২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে পল্লী এলাকায় ৬৩ হাজার ৬৫৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ৩ লাখ
৭৬ হাজার ব্রিজ-কার্লভার্ট, ১ হাজার ৬৮৫টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, ৯৩৬টি সাইক্লোন
সেন্টার এবং ২৪৯টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

যোগাযোগ

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জানান, ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৫৩ কিলোমিটার
জাতীয় মহাসড়ক চার বা তার বেশি লেইনে উন্নীত করা হয়েছে। আরও ৬৬১ কিলোমিটার মহাসড়ক তার
বেশি লেইনে উন্নীত করার কাজ চলছে। ঢাকায় বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬.৭৩ কিলোমিটার
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হবে।   

২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৪৫১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ১ হাজার
১৮১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৪২৮টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কিছুদিন
আগে যমুনা নদীর উপর ৪.৮ কিলোমটির দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ভিত্তি স্থাপন হয়েছে।
লোকোমোটিভ যাত্রীবাহী ক্যারেজ এবং মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ করা হয়েছে ১ হাজার ৪০টি। এছাড়া
রেলওয়েতে ১৩৭টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে বলে তথ্য দেন তিনি।

বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের বিমানবহরে ১২টি নতুন অত্যাধুনিক বোয়িং এবং
ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, গত মাসে একটি ড্যাশ-৮-৪০০
উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। চলতি মাসে আরও দুটি ড্যাশ-৮-৪০০ উড়োজাহাজ সংযোজিত হবে।

স্বাস্থ্য

গত এক যুগে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে ‘ব্যাপক ইতিবাচক
পরিবর্তন’ এসেছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, সারা দেশে সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র
থেকে গ্রামীণ নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিনামূল্যে
৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে তাদের।

“আমাদের স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ এবং গুণগত মানোন্নয়নের ফলে মানুষের
গড় আয়ু ২০১৯-২০ বছরে ৭২.৬ বছরে উন্নীত হয়েছে। ৫-বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে
২৮ ও অনুর্ধ্ব ১ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ১৫-তে হ্রাস পেয়েছে। মাতৃমৃত্যু হার কমে
দাঁড়িয়েছে প্রতি লাখে ১৬৫ জনে।”

শিক্ষা

মহামারীর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হলেও অন-লাইনে এবং স্কুল পর্যায়ের
জন্য টেলিভিশনে শিক্ষা কার্যক্রম যে চালু রাখার চেষ্টা হয়েছে, ভাষণে সে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই বিতরণ শুরু হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে
প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি টাকা শিক্ষার্থীর মধ্যে ২ হাজার ৯৫৮
কোটি টাকার বৃত্তি-উপবৃত্তি বিতরণ করা হয়েছে। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা
ট্রাস্ট্রের আওতায় স্নাতক ও সমমানের শ্রেণির আরও ২ লাখ ১০ হাজার ৪৯ জন শিক্ষার্থীর
মধ্যে প্রায় ১১১ কোটি বিতরণ করা হয়েছে।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের
১ হাজার টাকা করে কিট অ্যালাউন্স দেওয়া হবে। সেজন্য ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে
বলে জানান শেখ হাসিনা। 

তিনি বলেন, দেশের ৭ হাজার ৬২৪টি এমপিও-ভুক্ত মাদ্রাসায় ১ লাখ ৪৮ হাজার
৬১ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে প্রতিমাসে ২৭৬ কোটি টাকা বেতন ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ২০২০ সালে
নতুন করে ৪৯৯টি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।

১ হাজার ৫১৯টি এবতেদায়ী মাদ্রাসার ৪ হাজার ৫২৯ জন শিক্ষককে ত্রৈমাসিক ৩
কোটি ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হচ্ছে। দাওয়ারে হাদিস পর্যায়কে মাস্টার্স সমমান দেওয়া
হয়েছে। সারাদেশে ৫৬০ টি মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মহামারীর সময় মানুষের চলাচল যখন সীমিত হয়ে পড়েছে,
তখন ডিজিটাল প্রযুক্তি যোগাযোগের এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত
হচ্ছে।

“আমাদের সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ গ্রহণের
ফলেই এই ক্রান্তিকালে ডিজিটাল প্রযুক্তি ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।”

তিনি জানান, দেশের ১৮ হাজার ৪৩৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ৩ হাজার ৮০০ ইউনিয়নে
ফাইবার অপটিক কেবল স্থাপনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাসের সময় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।
অন-লাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং লেনদেন সুবিধা গ্রহণ করে সাধারণ মানুষ ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রা
অব্যাহত রাখতে’ পারছে।

নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১-এর মাধ্যমে দেশের সবগুলি টেলিভিশন চ্যানেলের
অনুষ্ঠান সম্প্রচার ছাড়াও প্রত্যন্ত ৩১টি দ্বীপে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি
ব্যাংক এবং সেনাবাহিনী স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১-এর সেবা নিচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

সামাজিক সুরক্ষা

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা,
বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের
শিক্ষা উপবৃত্তি, চা শ্রমিক, বেদে সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠিসহ দূরারোগ্য ব্যক্তিদের
চিকিৎসা বাবদ সর্বমোট ৬ হাজার ৫২০ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, প্রায় ৯০ লাখ
৫০ হাজার মানুষ এর উপকার পাবে বলে ভাষণে জানান প্রধানমন্ত্রী।

আন্তর্জাতিক অঙ্গন

শেখ হাসিনা বলেন, “বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ আজ একটি সমীহের নাম। জাতিসংঘের
বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব আজ চোখে পড়ার মত।”

‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- জাতির পিতার এই নীতিকে
পাথেয় করে আমরা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী
দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।

দুর্নীতিতে ছাড়
নয়

জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের যে মহাসড়ক বেয়ে
দুর্বার গতিতে ধাবিত হচ্ছে, তা যেন কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত হতে না পারে সেদিকে আপনাদের
সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।”

তিনি বলেন, উন্নয়নের পথে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকার বদ্ধপরিকর।

“কিছু অসাধু মানুষ নানা কৌশলে জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত
থাকে। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক আর যত
শক্তিশালীই হোক, তাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে না এবং হবে না।”

আইনের শাসন সমুন্নত রেখে মানুষের নাগরিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত
করতে যা যা প্রয়োজন, সরকার তা করবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।