মার্কিন হাউজের বিচারবিভাগীয় কমিটির বেশিরভাগ ডেমোক্র্যাটই বুধবার সন্ধ্যায় ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন।
বিবিসি জানায়, এ চিঠিতেই তারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘ক্যাপিটলে হামলা উস্কে দিয়ে গণতন্ত্রকে অবমাননা করার চেষ্টা’র অভিযোগ করে বলেছেন, সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী প্রয়োগ করে তাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক।
২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী, কোনও প্রেসিডেন্ট শারিরীক বা মানসিকভাবে অসুস্থতার কারণে ‘দায়িত্ব পালনে অক্ষম’ হলে মেয়াদ শেষের আগেই তাকে সরিয়ে দেওয়া যায় এবং ক্ষমতা সাময়িক কিংবা স্থায়ীভাবে ভাইস-প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দেওয়া যায়। ভাইস প্রেসিডেন্ট সেক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসাবে কাজ চালাতে পারেন।
তাছাড়াও, এই সংশোধনীর চার নং ধারায় বলা আছে, কোনও প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না পারলে তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পদক্ষেপ নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তারা প্রেসিডেন্টকে দায়িত্ব পালনে অপারগ হিসাবে গণ্য করে বিষয়টি কংগ্রেসকে জানাতে চিঠি দিতে পারেন।
এরপর নিয়মানুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট সাময়িকভাবে দায়িত্ব নিতে পারেন।তবে তার জন্য কংগ্রেসে ভোটাভুটিও করতে হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরাতে প্রতিটি চেম্বারেই প্রয়োজন পড়বে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের।
বাইডেনের জয়ের স্বীকৃতি দিল যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস
অবশেষে হার স্বীকার, ‘নিয়ম মাফিক ক্ষমতা হস্তান্তরের’ প্রতিশ্রুতি ট্রাম্পের
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে ট্রাম্প সমর্থকদের নজিরবিহীন হামলা, নিহত ৪
ক্যাপিটলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলায় ‘স্তম্ভিত বিশ্ব’
বুধবার মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের জয়ের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলার সময় ক্যাপিটল ভবনে ঢুকে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় ট্রাম্প সমর্থকরা। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালাতে হয় পুলিশকে। অন্তত চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে স্তম্ভিত হয়েছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোও বলছে ট্রাম্পের উস্কানিতেই হামলা হয়েছে।
নির্বাচনের আগে-পরে তার অসংযত আচরণ, ভোটের ফল পক্ষে না এলে তা মেনে না নেওয়ার কথা আগে থেকেই বলে আসছিলেন ট্রাম্প। সেকথা অক্ষরে অক্ষেরে পালনও করেছেন তিনি। এমনকী সর্বশেষ জর্জিয়ায় সিনেট নির্বাচনে দুই রিপাবলিকান প্রার্থী হেরে যাওয়ার পরও তা তিনি মানতে চাননি। আর এরপর ক্যাপিটলে হামলার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় রচনা করেছে।
হাউজের বিচারবিভাগীয় কমিটির সব ডেমোক্র্যাটদের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে মানসিকভাবে অসুস্থ তাই তিনি দেখিয়ে দিলেন। আর এখনও তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল মেনে নিতে অক্ষম। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার এও দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি গণতন্ত্রকে রক্ষা করা এবং প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক।
মার্কিন সেনেটের ডেমোক্র্যাটিক নেতা চাক শুমার অবিলম্বে ট্রাম্পকে সরানোর ডাক দিয়ে বলেছেন, তার আর একদিনও ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়। কেবল ডেমোক্র্যাটরাই নয়,গণমাধ্যমগুলোও অবিলম্বে ট্রাম্পের অপসারণ চাইছে।
‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ট্রাম্পকে সরানোর ডাক দিয়ে বলা হয়েছে, তার প্রেসিডেন্ট পদে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত আইন-শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আরও কয়েকটি সংবাদপত্রেও ধ্বনিত হয়েছে একই সুর।
ট্রাম্পেরই মন্ত্রিসভায়ও আলোচনা
খোদ ট্রাম্পের মন্ত্রিসভাই তাকে সরাতে ২৫তম সংশোধনী নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে বলে জানানো হয়েছে সিবিএস নিউজ এবং সিএনএন এর প্রতিবেদনেও। সিএনএন সংবাদদাতা জানিয়েছেন,আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
সিবিএস নিউজ জানায়,মাইক পেন্সের কাছে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। তাছাড়া, মন্ত্রিসভাতেও ট্রাম্পকে সরানোর পক্ষে যথেষ্ট সমর্থন আছে কিনা তাও এখনও পরিষ্কার নয়।
আরও একটি বিষয় হচ্ছে, ২৫ তম সংশোধনীর চতুর্থ ধারা ১৯৬৭ সালে এই সংশোধনী গৃহীত হওয়ার সময় থেকে আজ পর্যন্ত কখনও ব্যবহার করা হয়নি। তারপরও এ পদ্ধতিতেই ট্রাম্পকে সরানোর ডাক ক্রমেই জোরাল হচ্ছে। কিছু রিপাবলিকানও এ প্রক্রিয়ায় সমর্থন দিচ্ছেন।
সংকটকালের নেতা হয়ে সামনে এসেছেন পেন্স:
ক্রান্তিকালে এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বদলে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের ভূমিকা চলে এসেছে বেশ খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে।
ট্রাম্প সমর্থকরা ক্যাপিটল হিলে হামলা চালানোর সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে ত্বরিৎ গতিতে কাজ করতে দেখা গেছে ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সকে। বাজে পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন তিনিই।
ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করে বিক্ষোভ সামলানোর ব্যবস্থা করা, এমনকী পেন্টাগনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ন্যাশনাল গার্ড ডাকার কাজটিও তিনিই করেছেন। ট্রাম্প তখন ছিলেন অনেকটাই নির্লিপ্ত। তাকে এমনকী ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করতে রাজিও করাতে হয়েছে বলে জানিয়েছে সিএনবিসি নিউজ। ফলে পেন্সই সংকটকালে বিশেষ ভূমিকা রেখে প্রকৃত নেতা হয়ে উঠেছেন।
ট্রাম্প অবশ্য পরে নানা কথা বলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। টেলিভিশনের পর্দায় ওভাল অফিস থেকে সমর্থকদের তাণ্ডব দেখার প্রায় এক ঘণ্টা পর টুইট করে তিনি বিক্ষোভকারীদের ‘শান্ত থাকা উচিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ট্রাম্প জানুয়ারির ২০ তারিখ নিয়ম অনুযায়ী তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
কিন্তু একইসঙ্গে তিনি তার মিথ্যা দাবির পুনরাবৃত্তি করেছেন এমনকী বিক্ষোভকারীদের ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্পের এই তালগোলে তার ওপর আর ভরসা নেই। অনেকেই তাকে আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় দেখতে চাইছেন না, চলছে আলোচনাও। যদিও মাইক পেন্স কিংবা ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা ২৫ তম সংশোধনী প্রয়োগ করবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে এ পদ্ধতি ছাড়াও ট্রাম্পকে সরানো যেতে পারে আরও দুটি পন্থায়। আর তা হচ্ছে:
*অভিশংসন: ট্রাম্প এরই মধ্যে একবার অভিশংসিত হয়েছেন। যদিও তাকে তখন ক্ষমতা থেকে সরানো হয়নি। কিন্তু এবার ক্যাপিটল ভবনে বুধবারের হাঙ্গামার পর এর জন্য প্রেসিডেন্টকেই দোষারোপ করে তার বিরুদ্ধে অভিশংসনের নতুন খসড়া আর্টিকেল তৈরি করতে শুরু করেছেন কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর।
‘ফরচুন’ ম্যাগাজিনের খবরে বলা হয়েছে, ওমর লিখেছেন,“হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভসের (প্রতিনিধি পরিষদ) উচিত ট্রাম্পকে অভিশংসন করা। আমরা তাকে প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে দিতে পারিনা। এটি আমাদের প্রজাতন্ত্রকে রক্ষার ব্যাপার এবং আমাদের সেই শপথ পূরণ করা উচিত।”
ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত হাউজে ট্রাম্প আরও একবার অভিশংসনের মুখে পড়তে পারেন। হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ট্রাম্পকে ২৫ তম সংশোধনীর মাধ্যমে সরানো না হলে হাউজ তাকে অভিশংসন করার পথে এগুবে। হাউজের প্রায় ৬০ জন ডেমোক্র্যাটিক সদস্য ট্রাম্পকে অভিশংসনের পক্ষে রয়েছে।
*প্রস্তাবনা: প্রস্তাবনা আনার মধ্য দিয়ে কংগ্রেস সদস্যরা একে অপরকে সেখান থেকে বহিস্কার করার পদক্ষেপ নিতে পারেন। মিজৌরির ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য কোরি বুশ সে পথেই হেঁটে ক্যাপিটলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
তার কথায়, এই সহিংসতা যারাই উস্কে দিয়েছে তাদেরই পরিণতি ভোগ করা উচিত। আর সেকারণেই দায়ীদের কংগ্রেস থেকে বহিস্কারের ডাক দিয়ে তিনি একটি প্রস্তাবনা আনবেন বলে জানিয়েছেন। খসড়া প্রস্তাবনার একটি স্ক্রিনশটও তিনি শেয়ার করেছেন।
তাতে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী ফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করা কংগ্রেস সদস্যরা সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ ভঙ্গ করা কিংবা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ম ভঙ্গ করেছে কিনা তা তদন্ত করে দেখে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে কমিটি অন হাউজ অ্যাডমিনস্ট্রেশন এবং কমিটি অন এথিকস-কে। আর এর ভিত্তিতে দায়ীদের প্রতিনিধি পরিষদ থেকে বহিস্কার কিংবা নিষেধাজ্ঞার শাস্তিবিধান করতেও বলা হয়েছে।
এই সব পন্থার কোনও একটির প্রয়োগে ট্রাম্পকে মেয়াদ শেষের আগেই ক্ষমতা থেকে সরতে হবে কিনা তা এখনও পরিষ্কার না হলেও ২০ জানুয়ারিতে জো বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার আগের ১৩টি দিনে কিছু বিপদের পট প্রস্তুত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে।
শেষ সময়ের বিপজ্জনক ১৩ দিন:
ক্যাপিটল ভবনে হামলার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে ভয়াবহ যে সত্য বেরিয়ে এসেছে তা হল, প্রেসিডেন্টের ম্যানিয়া; উন্মত্ততার বশে যিনি তার বিদ্রোহী বাহিনীকে জাতীয় আইনসভার ওপর চড়াও হতে লেলিয়ে দিয়েছেন। আর এভাবে তিনি রাজনৈতিক বিভেদ, বৈরিতাকে এতটাই প্রকট করে তুলেছেন যে, ক্ষমতা থেকে তার বিদায়ের দীর্ঘদিন পরও তা পুঞ্জীভূত হয়ে থাকবে।
অনেকেই বলছেন, বুধবারের হামলার ঘটনাটি ছিল ট্রাম্পের অভ্যুত্থান চেষ্টা। ট্রাম্পের মানসিক স্থিতিশীলতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। আর তাই ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ একজন প্রেসিডেন্ট আবারও কোনও সংকট সৃষ্টি করতে পারেন বলেও সংশয় আছে।
তাছাড়া, ক্যাপিটলে হামলার ঘটনাটি লজ্জাজনক একটি অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে কিনা বা দেশে ফাটল ধরানো এক প্রেসিডেন্টের আমলের দুঃসহ স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে কিনা সামনে চলে এসেছে সে প্রশ্নও। আরও একটি বিষয় হচ্ছে, ট্রাম্প কেবল তার গুটিকয়েক সমর্থকের মধ্যেই তিক্ত অনুভূতির সৃষ্টি করেননি বরং তার কার্যকলাপে দেশের একটা বড় অংশজুড়ে গণতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া বেশিরভাগ ভোটারই সহিংস না হলেও তাদের লাখো জন ট্রাম্পের কথাতেই বিশ্বাস করেন এবং তাদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলেই ভাবেন। আর এ থেকেই বুধবারে ঘটে যাওয়া অস্থিরতার ঘটনাটি ব্যর্থ প্রেসিডেন্সির এক সহিংস আন্দোলনই কেবল নয় বরং বিষাক্ত এক শক্তি হিসাবে উদ্ভূত হয়েছে।
যে শক্তি দেশে বিভক্তি দূর করার ক্ষেত্রে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আশা কেবল গুড়ে বালি করে দেওয়াই নয় বরং ট্রাম্প চলে যাওয়ার পর বিভক্তি আরও বাড়া এবং অবিরাম উগ্রবাদ মোকাবেলা করে যাওয়ার পটও প্রস্তুত করার শঙ্কা বাড়িয়েছে।