শনিবার
রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে তারা সতর্ক করেছেন, প্রথম ধাপে যদি আস্থার সংকট
কিংবা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তাহলে পুরো কার্যক্রম ভেস্তে যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর
রহমান বলেন, “ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের মধ্যে যেন বঞ্চনার অনুভূতি বা বিভক্তি তৈরি না
হয়।”
নিজের
বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, টিকা কার্যক্রমের সফলতা নির্ভর করে স্বচ্ছতার উপর।
যত স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রক্রিয়াটি হবে, মানুষের সঙ্গে বার বার আলাপ করে হবে, তাতে গ্রহণযোগ্যতা
পাবে।
“সত্যিকারের
ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের দেওয়া হবে, ঝুঁকিগ্রস্ত মানুষকে সেবা-সহায়তার জন্য যারা কাজ
করছেন, তাদেরকে দেওয়া হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে যাদের কম ঝুঁকি তাদেরকে দেওয়া হবে।”
ঔষধ
প্রশাসন অধিদপ্তর ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার
টিকা আমদানি ও বাংলাদেশে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকা
ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও মর্ডানা, রাশিয়ার গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং চীনের
সিনোভ্যাক টিকা তৈরি করেছে। তবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার
তিন কোটি ডোজ টিকা আমদানিই নিশ্চিত করেছে।
এছাড়া
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস বা
গ্যাভি এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের গড়া প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্স-এর
আওতায় আরও আড়াই কোটি ডোজ টিকা আগামী জুনের মধ্যে বাংলাদেশ পাবে বলে সরকার আশা করছে।
টিকা
আসার অপেক্ষার মধ্যে বিএমএ মিলনায়তনে বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএইচআরএফ)
আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক সংলাপে মূল প্রবন্ধ
উপস্থাপন করেন অধ্যাপক সায়েদুর।
বাংলাদেশ
ও বিশ্বের ভ্যাকসিন কার্যক্রমের নানা দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, “ভ্যাকসিন কারা পাবে,
এই প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো না দিলে সমাজে একটি অস্থিরতা, বঞ্চনার অনুভূতি তৈরি হবে।
ভ্যাকসিন কারা পাবে, সেটা যদি যৌক্তিকভাবে বা বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্ধারণ করা না হয়
এবং সে সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়াও জরুরি।
“ভ্যাকসিনের
কার্যক্রমে সাফল্য নির্ভর করে এটার গ্রহণযোগ্যতার উপরে। যদি আস্থার জায়গাটা দুর্বল
হয়, তাহলে এই কর্মকাণ্ড ঠিকমতো চালানো সম্ভব হবে না।”
অধ্যাপক
সায়েদুর বলেন, “১৭ কোটির মধ্যে প্রথমে দেড় কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। কোন দেড় কোটি
মানুষকে দেওয়া হবে, তা কতোটা বিজ্ঞান ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং আমাদের দেশের প্রত্যাশার
সঙ্গে মেলে- এভাবে যদি না ঘটে তাহলে মানুষের আস্থা কমে যাবে, তা দ্বিতীয় পর্যায়ের ভ্যাকসিনের
সময় প্রভাব ফেলবে।”
পশ্চিমা
দুনিয়ায় প্রায় অর্ধেক মানুষ টিকা না নেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “যদি বাংলাদেশে
এটা ঘটে, তাহলে কী হবে? কোনো একজন মানুষ যদি ভ্যাকসিন নিতে না চায় তাহলে ওই বাড়ি, বাসায়,
অ্যাপার্টমেন্টে, কমিউনিটিতে কেবল তিনি নন, অন্যরাও ঝুঁকিতে থাকবে। এই ঝুঁকির মাধ্যমে
ভ্যাকসিনেশনের সুবিধাটাই কমিয়ে দিচ্ছেন।”
অন্য
ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উদ্যোগী
হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আলোচনায়
যোগ দিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবেলা এবং টিকা ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকার
সমালোচনা করেন বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব।
তিনি
বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজে স্বচ্ছ নয়। তাদের মাথায় কী
আছে, আমার বুঝের অভাব আছে। তাদের অব্যবস্থাপনার জন্য জাতি এর আগেও ভুগেছে। আমি মনে
করি, তারা আগামীতেও আমাদের ভোগাবে।”
ভারত
থেকে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন আসা নিয়ে ধোঁয়াশা দূর করার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব
বলেন, “এক্ষেত্রে ধোঁয়াশা রয়েছে। এটা কি বেক্সিমকো আনছে, না আমরা আনছি? বেক্সিমকো যদি
না এনে থাকে তাহলে সে কি দালালি নিচ্ছে?
“বাংলাদেশ
সরকার কেন সরাসরি আনতে পারল না, এটা আমাদের জানতে হবে। তা না হলে এটা (ধোঁয়াশা) থাকবে।”
তিনি
বলেন, “আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রণালয় আমাদেরকে তথ্য সঠিকভাবে দিচ্ছে কি-না?…
“আজকে
রাশিয়া ও চীনতো আমাদের কাছে (টিকা পাঠাতে) চাইতেও পারত। তাদের জন্য দরজাটা বন্ধ রাখছেন
কেন? তারা কীভাবে দেবে, আমাদের প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি আসে, তাহলে আমরা কিন্তু নিতে পারি।”
মোবাইল
অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করে টিকা দেওয়ার যে আলোচনা হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, “আপনারা
বলছেন, একটা অ্যাপ তৈরি করবেন। কতদিন লাগবে আপনাদের অ্যাপ তৈরি করতে? সেই অ্যাপে ঢুকতে
পারবে কি না। কারণ সেই অ্যাপের কোয়ালিটি কী রকম হবে? এগুলো কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
“আমি
মনে করি, বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
যে সাহস আছে, তাদের এক খণ্ডও থাকত তাহলে জাতি অনেক দূর এগিয়ে যেত। কিন্তু দুর্নীতি
করতে তো তাদের কোনো সমস্যা নাই।”
টিকা
নিতে অনীহার বিষয় নিয়ে রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, “সাধারণ মানুষকে কীভাবে দেবেন, সে তো ডাকলেও
আসবে না। আর যে জটিলতা আমরা দেখেছি, আমাদের পরীক্ষার নাম তালিকাভুক্তির জন্য… সাধারণ
মানুষ কিন্তু বিপদে পড়েছে। যারা ক্ষমতাবান, তাদের কিন্তু ভিন্ন কোটা আছে, সে কোটায়
তারা নিয়ে গেছে।”
ভার্চুয়ালি
সংলাপে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা
বলেন, প্রথম দফায় ৫০ লাখ টিকা আসবে। কারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পাবে, সেটা তারা
ইতোমধ্যে নির্ধারণ করেছেন। অনলাইন ও মোবাইল অ্যাপে নিবন্ধনের মাধ্যমে তা সম্পন্ন হবে।
অগ্রাধিকার
তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি, যাদের মাধ্যমে সংক্রমণ
ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং সংক্রমিত হলে যাদের মধ্যে জটিলতা বা মৃত্যু ঝুঁকি বেশি,
সেই ক্রাইটেরিয়া মাথায় নিয়ে অগ্রাধিকার গ্রুপ ঠিক করেছি।
“অগ্রাধিকার
গ্রুপ ঠিক করার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও কিছু পরামর্শ রয়েছে। আমাদের টিকাদান
কর্মসূচির যে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে, তাদের কাছ থেকেও পরামর্শ নিয়েছি।”
সেব্রিনা
ফ্লোরা বলেন, “যারা পাবেন তাদের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে আমরা অনলাইন রেজিস্ট্রেশন নিয়ে
কাজ করছি এবং আমাদের যে অ্যাপটা তৈরি করা হবে তা প্রায় সম্পন্নের পর্যায়ে।
“টিকা
কোথা থেকে দেওয়া হবে, কাদের মাধ্যমে দেওয়া হবে, জনবল কারা হবে, তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়
সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।”
টিকা
কার্যক্রমকে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “প্রথম ধাপে আমরা ৫০ লাখ টিকা
পাব, যেটা আমরা কিনেছি সেখান থেকে। কোভ্যাক্স থেকে কখন পাব সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। বলা
হচ্ছে ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে। প্রথম প্রান্তিকের মধ্যে পাব, সেটাও বলা হচ্ছে।
“প্রথম
দফায় যারা টিকা পাবেন, তাদেরকে আলাদা করে টিকা দেওয়া, কারণ সবার মধ্যে টিকা পাওয়ার
একটা প্রত্যাশা রয়েছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।”
স্বাস্থ্য
অধিদপ্তরের এই অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, “কখন কোন গ্রুপ টিকা পাবেন, আমরা প্রচার-প্রচারণার
মাধ্যমে তা প্রকাশিত করেই টিকাটা দিব। যারা পাবেন কি পাবেন না এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন,
তারা জানতে পারবেন, তিনি পাবেন এবং কবে পাবেন।”
নতুন
টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও বড় রকমের চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যেহেতু
টিকাগুলো নতুন, সেহেতু এখান থেকে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকতেই পারে।
“যে
কোনো টিকা বা ওষুধ থেকে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়, সেটা ব্যবস্থাপনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া,
আমাদের কিছু ভেরিফাই কমিটি আগে থেকে রয়েছে, ইপিআইয়ের, সেটার মাধ্যমে এটা কীভাবে নিশ্চিত
করা যায়, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার পর ব্যবস্থাপনা আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে।”
বিএইচআরএফ
সভাপতি তৌফিক মারুফের সভাপতিত্বে সংলাপে অন্যদের মধ্যে বিএমএ সভাপতি মোস্তফা জালাল
মহিউদ্দীন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব এম এ আজিজ বক্তব্য দেন।