ক্যাটাগরি

পি কে হালদারের সাক্ষাৎকার প্রচার: একাত্তর টিভির বক্তব্য শুনবে হাই কোর্ট

আগামী ১৭ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখ রেখে এ সময়ের মধ্যে একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষকে মৌখিক বা লিখিতভাবে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে।

দুদকের পক্ষ থেকে রোববার একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারির আবেদন করা হলে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ রুল না দিয়ে এ আদেশ দেয়।

আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।

আর পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ও পি কে হালদারের আত্মীয় উজ্জ্বল কুমার নন্দীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোশারফ হোসেন।

গত ২৮ ডিসেম্বর রাতের খবরে পালাতক পি কে হালদারের বক্তব্য প্রচারের পর এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তাকে সরাসরি যুক্ত করে একাত্তর টিভি।

দুদকের আইনজীবী বিষয়টি নজরে আনলে গত ৩০ ডিসেম্বর আদালত পি কে হালদারসহ যে কোনো দণ্ডিত ও পলাতক আসামির বক্তব্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার-সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

পরবর্তী আদেশ অথবা পি কে হালদার সংক্রান্ত জারি করা রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব ধরনের প্রচার মাধ্যমের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর বলে আদালতের আদেশে জানানো হয়।

সেই আদেশেই একাত্তর টিভির খবর ও আলোচনা অনুষ্ঠানে পি কে হালদারের প্রচারিত বক্তব্য ও সাক্ষাতকারের ভিডিও ক্লিপ তলব করে হাই কোর্ট।

একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষ সে অনুযায়ী রোববার হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার গোলাম রব্বানীর দপ্তরে ভিডিও ক্লিপ জমা দেয়। আদালতের নির্দেশে শুনানির সময় ওই ক্লিপ দুটি বাজানো হয়।

পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার ও ফিরিয়ে আনার ব্যপারে আদালতের জারি করা রুল এবং পি কে হালদারের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি তুলে ধরে শুনানিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষ, সাংবাদিক, উপস্থাপকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা প্রশ্নে রুল জারির আরজি জানান।

তিনি বলেন, বিচারাধীন মামলার একজন পলাতক আসামির বক্তব্য, সাক্ষাৎকার প্রচার করে একাত্তর টিভি ‘আদালতকে অগ্রাহ্য’ করেছে।

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক নজরুল ইসলাম তালুকদার তখন বলেন, জাহালম, তারেক রহমানের নামে সেই আদেশ হয়েছে। কমন কোনো আদেশ নেই।

খুরশীদ আলম খান তখন বলেন, “সব কিছুতে কমন আদেশ থাকবে না। একাত্তর টিভিতে একটি নির্দিষ্ট ইস্যু- পি কে হালদারকে নিয়ে সাংবাদ প্রচার করেছে। সেখানে আমার ইন্টারভিউ নিয়েছে। তারপর আবার আধা ঘণ্টা পরে একাত্তর জার্নালে আমাকে ডাকার মানেটা কি?

“আমি তো একই দিনে একই সময়ে বলেই দিয়েছি উনি আইনের চোখে পলাতক। উনাকে আপনারা আনতে পারেন না। আবার আমাকে নেওয়ার মানে কি? এর পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? এটা তো আদালত অবমাননার শামিল। উনাদের তো এর ব্যাখ্য দিতে হবে। উনাদের সাথে পি কে হালদারের কোনো যোগাযোগ আছে কিনা।”

বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার তখন বলেন, “তাহলে আমরা একাত্তর টেলিভিশনকে শুনি। আমরা আগে শুনতে চাই।”

খুরশীদ আলম খান বলেন, “শুনলে শোকজ আকারেই তো শুনতে হবে।”

বিচারক বলেন, “না না শোকজ দরকার নাই, এমনিই শোনা যাবে।”

উজ্জ্বল নন্দীর আইনজীবী মোশারফ হোসেন এ সময় বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে যে, কোর্টের প্যারালাল কিছু মনে করে নাই একাত্তর টেলিভিশন।”

খুরশীদ আলম খান তখন বলেন, “একটা টকশোর একটা শব্দ চয়ন দেখে পুরা টকশোটা এক্সামিন করা যাবে না।”

বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার তখন বলেন, “তাদের সামনে (একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষ) কিন্তু উচ্চ আদালতের কোনো আদেশ ছিল না।

খুরশীদ আলম খান বলেন, “সবকিছুতে আদালতের আদেশ থাকতে হবে কেন?”

বিচারক বলেন, “ঠিক আছে, আমরা একাত্তর টিভিকে শুনতে চাই। আমরা শোকজ করব না। তাদের ব্যাখ্যায় যদি কোনো ঘাটতি থাকে তখন দেখা যাবে। তাদের কোনো বক্তব্য থাকতে পারে। ফলে আজকে আমরা কোনো আদেশ দেব না। আমরা একাত্তরকে না শুনে কোনো আদেশ দেব না।”

দুদকের আইনজীবী বলেন, “একাত্তর টিভিকে কখন আপনারা শুনবেন সে আদেশটা তো লাগবে।”

বিচারক তখন বলেন, “এমনিই আমরা শুনব।”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক তখন জানান, একাত্তর টিভির একজন সাংবাদিক ভার্চুয়াল আদালতের শুনানিতে যুক্ত আছেন।

আদালত ওই সাংবাদিকের কাছে জানতে চায়, একাত্তর টিভি কবে তাদের বক্তব্য জানাতে পারবে। ওই সাংবাদিক নিজে, একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষ অথবা কোনো আইনজীবী- যে কেউ সেই বক্তব্য জানাতে পারবেন।

পরে মামলার পরবর্তী তারিখ রেখে বিচারক বলেন, “একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য না শুনে আমরা আজকে এই বিষয়ে কোনো আদেশ দিচ্ছি না। আগামী ১৭ জানুয়ারি বিষয়টি আবার আসবে। এই তারিখে একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হল ব্যক্তিগত হাজিরা দিয়ে অথবা আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিতভাবে বক্তব্য জমা দিতে।”

প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)

প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)

প্রেক্ষাপট

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।

এই চার কোম্পানি হল- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।

এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অংকের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।

এর মধ্যে আইএলএফএসএল গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে গত বছরের শুরুতে পি কে হালদারের বিদেশ পালানোর পর দুদক তার ৩০০ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদের’ খবর দিয়ে মামলা করে।

বিদেশে থাকা পিকে হালদার গত ২৮ জুন আইএলএফএসএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে তার দেশে ফেরার জন্য ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেন।

আদালত তাতে অনুমতি দিলেও পিকে হালদার না ফেরায় ইন্টারপোলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে ঢাকার জজ আদালত ইতোমধ্যে পি কে হালদারের সব স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করারও আদেশ দেয়।

এদিকে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনানশিয়াল সার্ভিস লিমিটেডের চারজন ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারী তাদের আমানত ফিরে পেতে গত ৩ জানুয়ারি আদালতের কাছে আকুতি জানান।

এই চারজন হলেন- সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়ে নাশিদ কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মো. শওকতুর রহমান, খালেদ মনসুর ট্রাস্ট্রের হিসাব শাখার কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম এবং গৃহিনী সামিয়া বিনতে মাহবুব।

আরেক আমানতকারী সাবেক রাষ্ট্রদূত রাজিউল হাসান সেদিন ভার্চুয়াল কোর্টে যুক্ত থাকলেও কোনো বক্তব্য দেননি।

আমানতকারীদের বক্তব্য শোনার পর আদালত বিষয়টি গত ৫ জানুয়ারি আদেশের জন্য রেখে এই পাঁচ আমানতকারীকে তাদের বক্তব্য হলফনামা আকারে দাখিল করতে বলে।

পরে তাদের আবেদনে গত ৫ জানুয়ারি পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও সাবেক সচিব ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এন আই খানসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে হাই কোর্ট।