বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে রোববার ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্যে এই অভিমত প্রকাশ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা অধ্যাপক রফিকুল ভার্চুয়ালি যোগ দেন। শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠানস্থলে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি সচিব বদরুল আরেফীন, একাডেমির সচিব নওসাদ হোসেন বক্তব্য রাখেন।
আলোচনার পাশাপাশি কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, সঙ্গীত ও নৃত্যালেখ্য এবং নৃত্যনাট্য ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা’য় মেলে ধরা হয় জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, “বঙ্গবন্ধু যদি ফেরৎ না আসতেন বাংলাদেশে… কী অবস্থা হত!”
তিনি বলেন, “এখানে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাদের মধ্যে নানা রকম বিভেদ ছিল, দলাদলি ছিল। একদিকে তো হল বিডিআর এবং সেনাবাহিনী নিয়ে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছিল, যাদের ভেতরে সেক্টর কমান্ডাররাও ছিলেন। আরেকদিকে ছিল মুজিববাহিনী, আরেকদিকে ছিল কাদেরিয়া বাহিনী, আরেকদিকে ছিল হেমায়েত বাহিনী।
“তারপরে স্বাধীনতার পর নতুন উপসর্গ দেখা দিল, সেটা হল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা, সর্বহারা দল। মুজিব নগর সরকারের মধ্যেই মীরজাফর ছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্য যে দায়ী, আপনারা জানেন যে মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ঘাতক ও অনুচররা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চলে এসেছিল।”
বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ভারতের সৈন্যদের ফেরানোও কঠিন হত বলে মনে করেন অধ্যাপক রফিকুল।
“তাহলে ভারতীয় সৈন্যরা তখন অবশ্যই বাংলাদেশ পরিত্যাগ করে যেত না। কারণ তার প্রতিবেশী দেশে এই ধরনের বিশৃঙ্খলা, এই ধরনের অবস্থা তার জন্য নিরাপদ ছিল না।”
“সুতরাং বঙ্গবন্ধু যদি না ফিরতেন, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যেত, আমাদের স্বাধীনতা ব্যর্থ হত। বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলেই আমাদের স্বাধীনতা স্থায়ী হয়েছে,” বলেন তিনি।
সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলেও তখনও পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার মুক্তি দিলে যুদ্ধে বিজয়ের ২৪ দিন পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নিজের স্বপ্নের স্বাধীন দেশে পা রাখেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নিজও বন্দি ছিলেন; প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে, পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
তার আলোচনায় উঠে আসে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ইস্পাত-কঠিন মনোবলের কথা।
“সেখানে বঙ্গবন্ধু দেশের খবর জানতে পারতেন না তেমন কিছু। জেলখানায় ভুট্টো নানা প্রলোভন দেখিয়েছেন তাকে (বঙ্গবন্ধুকে)। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে যদি পটানো যেত, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে পাকিস্তানের যে পরাজয় সেটা গোছানো যেত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো ফাঁদে পা দেননি।
“এখানে বঙ্গবন্ধুর যে সাহস, যে বলিষ্ঠতা, যে অপরিসীম ধৈর্য্য….. পাকিস্তানের সামরিক কারাগারে নয় মাসের উপর একটা মানুষকে বন্দি জীবনযাপন.. এর চেয়ে দুর্বিসহ জীবন আর কিছু হতে পারে না। তিনি সেটাকে অতিক্রম করেছেন, চরম ধৈর্য্য, পরম সাহস এবং আশার সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে যান লন্ডন। পরে সেখান থেকে আসেন ভারতের দিল্লিতে। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি অনুরোধ করেন বাংলাদেশ থেকে মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সরিয়ে নিতে। ইন্দিরা গান্ধীও অনুরোধ রাখেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের তিন মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ভারতের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ফিরে যান নিজ দেশে।
অধ্যাপক রফিকুল বলেন, ভারতের সেনাবাহিনীর ফিরে যাওয়ার উপর নির্ভর করছিল ব্রিটেনের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি পাওয়া।
স্বাধীন দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠিত করেছেন। নতুন নির্বাচন দিয়েছেন, নতুন পার্লামেন্ট দিয়েছেন, নতুন সংবিধান দিয়েছেন এবং পরে তিনি চেষ্টা করছিলেন যে স্বাধীনতার পক্ষের সমস্ত দলগুলোকে একত্রিত করে বাংলাদেশকে একটা উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়া, মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়া।
“সে সুযোগ তাকে দেওয়া হয়নি। ১৯৭৫, ১৫ আগস্ট তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আসবার কথা ছিল। সে সুযোগ আর তাকে দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানি গুপ্তচররা, বাংলাদেশি নামধারী তারা সর্বনাশটি ঘটিয়ে ঘটেছে।”
অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ভাষ্যে, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘মুক্তিযুদ্ধের শক্তি’ ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে সঠিক পথে নিয়ে আসে।
“দুই দশক তারা এই দেশে রাজত্ব করেছে। তারপরে আবার মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে তার সঠিক পথে নিয়ে এসেছে। আমরা আশা করি, আমরা যদি এই পথে থাকি, তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের উন্নতি অক্ষুণ্ন থাকবে। কেউ তার ব্যত্যয় ঘটাতে পারবে না।”