উচ্চ আদালতের এই রায়ে ‘লিঙ্গ বৈষম্যের প্রকাশ ঘটেছে’ দাবি করে সর্বোচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন এই সংক্রান্ত রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির।
তিনি সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ রায়ে জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন করা হয়েছে। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে পাবলিক ডিপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে কোনো জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন করা যাবে না। আমাদের সংবিধানে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা লিভ টু আপিল করব। গত বৃহস্পতিবার রায়ের নকল তুলেছি।”
মুসলিম বিয়ে নিবন্ধনে কোনো নারী ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার’ বা কাজী হতে পারবেন না বলে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে গত বছর হাই কোর্ট রায় দিয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে।
এই আইনি লড়াইয়ের সূত্রপাত হয় ২০১৪ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী হিসেবে নিয়োগের জন্য তিন নারীর নাম প্রস্তাব আসার পর। ওই প্যানেলে প্রথমেই ছিল আয়েশা সিদ্দিকা নামে এক নারীর নাম।
কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ্ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’ মত দিয়ে ওই প্রস্তাব বাতিল করে।
এরপর ওই বছরই সেকেন্দার আলী নামের একজনকে সেখানকার কাজী হিসেবে নিয়োগ দেয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন আয়েশা।
তাতে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং পরে সম্পূরক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেকান্দার আলীর নিয়োগ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল রুলে।
পরে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রুল খারিজ করে রায় দেয় বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাই কোর্ট বেঞ্চ। তাতে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই বহাল রাখা হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাই কোর্ট এই বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলেছে, “আমরা যেটা শুরুতেই বলেছি, প্রাথমিকভাবে দুজন মুসলিম যুগলের মধ্যে বিয়ে পড়ানোই একজন নিকাহ নিবন্ধকের কাজ, যা মূলত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
“শহরাঞ্চলে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান না থাকায় সম্প্রতি মসজিদে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, শারীরিক কিছু পরিস্থিতির কারণে একজন নারীর পক্ষে মাসের কোনো একটা সময় মসজিদে যাওয়া সম্ভব হয় না। ওই সময় একজন নারী বাধ্যতামূলক দৈনন্দিন প্রার্থনা থেকেও বিরত থাকেন। শারীরিক এই অযোগ্যতা ধর্মীয় অনেক কার্যক্রম করতে তাকে অনুমতি দেয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিয়ে মুসলমানদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা ইসলামের রীতিনীতি অনুযায়ীই হওয়া উচিৎ।”
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হুমায়ুন কবির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মইনুল ইসলাম। সেকেন্দার আলীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মহিউদ্দিন এম এ কাদের।
রায়ে সেকান্দার আলীর আইনজীবী মহিউদ্দিন কাদেরের আবেদন ও বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, একটি বিয়ে শুধু পারিবারিক ও সামাজিক বিষয় না, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাও। বিয়ে নিবন্ধনের কাজটি একজন নিকাহ নিবন্ধক নিজে করে থাকেন। অথবা করেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। উভয় পক্ষের দুজন সাক্ষীর উপস্থিতি এবং স্বাক্ষরে এ কাজটি কেবল কনের বাড়িতেই হয় না, স্থানীয় কোনো মিলনায়তন, এমনকি মসজিদেও হয়ে থাকে। দেশের গ্রামাঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা শহরাঞ্চলের মতো এতটা উন্নত না। গণপরিবহনও সচরাচর চলে না। ফলে গ্রামাঞ্চলে নিকাহ নিবন্ধক নিয়োগের সাথে এ বিষয়টা (যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা) সম্পর্কিত।
“মনে রাখতে হবে সারা বছরই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে বর্ষাকাল কয়েকমাস স্থায়ী হয়। ফলে সে সময়টা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া একজন নিকাহ নিবন্ধকের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অনেক সময় নৌকা দিয়ে নদী-খাল পাড়ি দিয়ে অনেক দূরেও যেতে হয় একজন নিবন্ধককে। ফলে কোনো ব্যক্তিকে গ্রামাঞ্চলে নিকাহ নিবন্ধক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা হালকাভাবে নিলে চলবে না বা অগ্রাহ্য করা যাবে না।”
অন্যদিকে রিট আবেদনকারীর আইনজীবী হুমায়ুন কবিরের বক্তব্য তুলে ধরে রায়ে বলা হয়েছে, “সংবিধান লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। যাই হোক, নিকাহ নিবন্ধকের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র বিষয়।”