ঐতিহাসিক ভবনটির সামনের
ভেঙে ফেলা অংশে একটি সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত
জেলা প্রশাসক (এলএ) বদিউল আলম ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তারের নেতৃত্বে
প্রশাসনের কর্মকর্তারা শনিবার বিকালে সেখানে উপস্থিত হয়ে এ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন।
জেলা প্রশাসনের এই
পদক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন রানা দাশগুপ্তসহ বাড়িটি রক্ষার দাবিতে
আন্দোলনরতরা।
ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা
যাত্রামোহন সেনগুপ্ত রহমতগঞ্জে ১৯ গণ্ডা জমির উপর এই বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের
এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত।
ওই জমি পরে ‘শত্রু
সম্পত্তি’ ঘোষিত হয়। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি
জমিটি ইজারা নিয়ে সেখানে স্কুল চালিয়ে আসছিলেন।
এর মধ্যে গত ৪ জানুয়ারি
এম ফরিদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি ওই জমি যাত্রামোহনের এক স্বজনের কাছ থেকে কেনার দাবি
করে আদালতের একটি আদেশ নিয়ে বাড়িটি ভাঙতে যান। সে সময় স্থানীয়দের নিয়ে তার এই তৎপরতা
ঠেকিয়ে দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। ওই দিন বাকলিয়া অঞ্চলের
সহকারী কমিশনার (ভূমি) বাড়িটিতে তালা ঝুলিয়ে দেন।
এরপর একটি রিট আবেদনের
প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট ওই বাড়ি ভাঙায় এক মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয়। জেলা প্রশাসনের আবেদনে
সাড়া দিয়ে চট্টগ্রামের আদালতও বাড়ি ভাঙায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাড়িটির
দখল নিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) বদিউল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,
“এটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা। চট্টগ্রামের ইতিহাসের
সাথে জড়িত। কিছু দুস্কৃতকারী অবৈধ অনুপ্রবেশ করে বাড়িটি ভাংচুর করে। এ বিষয়ে হাই কোর্টে
একটি রিটও হয়েছে। মহামান্য হাই কোর্ট রুল জারি করেছেন।
“পাশাপাশি ঐতিহাসিক
স্থাপনা রক্ষা সংবিধানের ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে সাংবিধানিক দায়িত্ব। হাই কোর্টের
আদেশ এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব অনুসারে অনুপ্রবেশকারীদের সরিয়ে আমরা এটার দায়িত্ব নিয়েছি।
এটা রক্ষা করেছি। জাদুঘর করার বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে। ২০১৮ সালের সংস্কৃতি বিষয়ক
মন্ত্রণালয়ের সভায় এ বাড়ির স্মৃতি সংরক্ষণের সিদ্ধান্তও আছে। পরিকল্পনা আছে জাদুঘর
করার।”
এখন থেকে বাড়িটি জেলা
প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং এর পাহারায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকবে বলেও জানান তিনি।
আন্দোলনকারীদের ‘বিজয়’
গত ৪ জানুয়ারির পর
থেকে রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা বাড়িটি
রক্ষায় ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছিলেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের
নগর ও কেন্দ্রীয় নেতারাও বিভিন্ন সময়ে এই আন্দোলনে সংহতি জানান এবং বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে
অবহিত করার আশ্বাস দেন।
২০ দিনের মাথায় বাড়িটি
দখলদারমুক্ত হওয়াকে আন্দোলনের বিজয় হিসেবে দেখছেন আন্দোলনকারীরা। দুপুরে জেলা প্রশাসন বাড়িটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগে
থেকেই বাড়ির সামনে অবস্থান নেন তারা।
সেখানে নগর আওয়ামী
লীগ সহ-সভাপতি নঈম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “আমরা দেশ স্বাধীন করেছি কারও জমি বাড়ি দখলের
জন্য নয়। এটা আমরা হতে দেব না। রানা দাশগুপ্ত আমাদের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।
সেই স্মৃতিরক্ষায় জাদুঘর করতে হবে। নেত্রীর উপর আপনারা ভরসা রাখতে পারেন। আজ আপনাদের
বিজয় ভূষিত হবে।”
জেলা আইনজীবী সমিতির
সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন বলেন, “চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা
যাত্রামোহন সেনগুপ্ত। বাড়িটি বিপ্লব স্মৃতি জাদুঘর করার দাবি জানাই।”
ওয়ার্কার্স পার্টির
সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান বলেন, “জনতার সংগ্রাম বিফল হয় না, তার দৃষ্টান্ত এটি। খুশি
হয়ে ঘরে ফিরে গেলে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর যতদিন হবে না
ততদিন রাজপথে থাকতে হবে। শুধু এই বাড়ি নয় ফয়’স লেক বধ্যভূমির সীমানা দেয়াল ভেঙে ইউএসটিসি
তার মালামাল নেওয়ার পথ করছে। আহ্বান জানাই সব বিপ্লবীদের স্মৃতি ও বধ্যভূমি রক্ষার
আন্দোলনে সবাইকে সঙ্গে পাব।”
জাসদ নেতা অ্যাডভোকেট
ইন্দু নন্দন দত্ত বলেন, “এক ব্যতিক্রমধর্মী আন্দোলনে বিজয়ক্ষণে আজ সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছি।
সব নেতারা বলেন সূর্যসেন প্রীতিলতার চট্টগ্রাম। দুর্ভাগ্যজনক এ শহরে সূর্যসেনের নামে
কিছু নেই। প্রীতিলতার নামে একটি সড়ক নেই। কল্পনা দত্তের নামে কিছু নেই।
“যাদের নিয়ে আমরা,
বাংলাদেশ, সারা ভারতবর্ষ বড়াই করে এই চট্টগ্রামের কেন্দ্রে তাদের আমরা রাখতে পারিনি।
যাত্রামোহন সেন ও যতীন্দ্রমোহন সেনের নামে কিছুই নেই। নেতারা আসে যায়, তাদের নাম বলে
গৌরব বোধ করে। আজ লজ্জা হল, তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হয়। যেখানে তা জাতীয় সম্পদ
হওয়ার কথা ছিল। এই ঐক্যকে সকল ঐতিহ্য রক্ষায় আরও সুসংহত করতে হবে।”
খবর পেয়ে অসুস্থ শরীরে
ছুটে আসেন শহীদজায়া ও ভগ্নি বেগম মুশতারী শফি। তিনি বাড়িটি রক্ষা করায় আন্দোলনকারীদের
ধন্যবাদ জানান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, নারীনেত্রী নূরজাহান খান, আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান, চট্টগ্রাম
ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ কেন্দ্রের সভাপতি আলিউর রহমান, লেখিকা নাসরিন সুলতানা খানম বলেন,
পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত প্রমুখ।
তাদের অবস্থানের মধ্যে
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা সেখানে আসেন। তারা দখলদারদের দেওয়া তালা
ভেঙে বাড়িতে প্রবেশ করেন।
তখন রানা দাশগুপ্ত
বলেন, “জেলা প্রশাসনকে এবং পুলিশ সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই। ঐতিহাসিক ভবনটি দখলদারদের
হাত থেকে রক্ষা করতে আমরা আন্দোলন করেছি। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, উনার দৃষ্টি
ছিল বলেই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এখন এসেছেন। নওফেলকে ধন্যবাদ তিনি তার বক্তব্যে যে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা রেখেছেন।”
জেলা প্রশাসনের পক্ষে
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম জাকারিয়া, সহকারী কমিশনার (ভূমি, বাকলিয়া) আশরাফুল হাসান
ও সহকারী কমিশনার (ভূমি, পতেঙ্গা) তৌহিদুল ইসলাম কার্যক্রম পরিচালনায় অংশ নেন।
বাইরে তালা, ভেতরে ছয় বাসিন্দা
বাইরের তালা ভেঙে বাড়ির
ভেতরে গিয়ে সেখানে ছয়জন বসবাসকারীর সন্ধান পান জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
ওই ছয়জন হলেন- কুমিল্লার
মুরাদনগরের জাহানারা (৫০), তার ছেলে জসিম (২২), পটিয়ার বিউটি (৩৫), পপি আক্তার (২৮)
এবং দুটি শিশু।
তারা বলেন, বিনা ভাড়ায়
থাকতে দেওয়ার কথা বলে ফরিদ চৌধুরীর লোকজন সেখানে নিয়ে এসেছিল। বাড়ির ভেতরে তোশক, কাঁথা-বালিশ
রেখে একটি কক্ষে থাকছিলেন তারা। সেখানে রান্নার উপকরণ এবং হাড়ি-পাতিল, পানির বড় জারও
দেখা গেছে। পরে তাদের বের করে দেওয়া হয়।
সেখানে একটি বেল্টে
বাধা কুকুরও ছিল। বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণে একটি অংশে বাঁশের খুঁটি গেড়ে ত্রিপল টাঙানো
হয়।
মূল ফটক ও সীমানা প্রাচীর
ধরে বিভিন্ন অংশে সিসি ক্যামেরাও বসিয়েছিল দখলকারীরা। এছাড়া তাদের লাগানো তিনটি নোটিশ
বোর্ডও সরিয়ে নেওয়া হয়।
এ সময় উপস্থিত আন্দোলনকারীরা
আনন্দে স্লোগান দিতে থাকেন। তারা বাড়িটির সীমানা দেয়ালের বাইরে ‘বিপ্লবী জাদুঘর নির্মাণের
নির্ধারিত স্থান’ লেখা একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন।
আরও পড়ুন:
যাত্রামোহনের বাড়িতে হানিফ, সংরক্ষণের আশ্বাস
যাত্রামোহনের বাড়ি জাদুঘর ঘোষণার দাবিতে সমাবেশ
যাত্রামোহনের বাড়ি রক্ষায় অনশনের হুমকি রানা দাশগুপ্তর
ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণের দাবি চট্টগ্রামের সমাবেশে