যশোরে সম্প্রতি পুলিশি নির্যাতনের যে অভিযোগ এসেছে, সে বিষয়েও উৎকণ্ঠা
প্রকাশ করেছে আদালত।
বিচারক বলেছেন, যশোরের ঘটনা ‘ভীতসন্ত্রস্ত’ করে তুলেছে। এই উৎকণ্ঠা নিরসন
করা পুলিশের দায়িত্ব।
গত ১৬ জানুয়ারি ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সুপার
তানভীর আরাফাত এবং পুলিশ সদস্যরা ‘অসৌজন্যমূক’ আচরণ করেন এবং দায়িত্ব পালনে বাধা দেন
বলে অভিযোগ করেছিলেন কুষ্টিয়ার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. মহসিন হাসান।
সেজন্য পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানিয়ে
গত ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেন বিচার বিভাগীয় এই কর্মকর্তা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ হলে গত ২০ জানুয়ারি পুলিশ সুপার এস এম
তানভীর আরাফাতকে তলব করে বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াতের ভার্চুয়াল
হাই কোর্ট বেঞ্চ।
সেই সাথে এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না,
তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।
পৌর নির্বাচনে ওই ঘটনা ঘটেছিল ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে।
সেখানে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন উপজেলার যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. শাহজাহান
আলী।
গত ২১ জানুয়ারি তিনি হাই কোর্টের আরেকটি বেঞ্চের ভার্চুয়াল শুনানিতে উপস্থিত
হয়ে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
এরপর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো.মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল
হাই কোর্ট বেঞ্চ শাহজাহান আলী ও তার পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেন।
এদিকে সোমবার তলবে হাজির হয়ে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার ভোটকেন্দ্রের ঘটনার
জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে নিঃশর্ত ক্ষমা চান।
শুনানির এক পর্যায়ে বিচারপতি খিজির হায়াত ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য
করে বলেন, ‘মিস্টার তানভীর, আপনার প্রেয়ার (আবেদন) শুনেছি। আপনি একজন সিনিয়র পুলিশ
অফিসার। একজন ডেকোরেটেড পুলিশ অফিসার। আপনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, স্বীকার করেছেন এবং আনকনডিশনাল
অ্যাপলজি চেয়েছেন।
আদালতে পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত
“আমরা আপনাকে বলছি, আপনি নিশ্চিত করবেন যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা শাহজাহান
আলীকে (ওই ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা) যেন কখনও হয়রানি না করা হয়। তাকে বা
তার পরিবারের কোনো ধরনের সমস্যা করা না হয়।”
বিচারক বলেন, “পুলিশের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের সুরক্ষা
দেওয়া, সে যেই হোক না কেন। কুষ্টিয়ার পরিবেশ যেটি উপস্থাপিত হয়েছে, সেটি যদি বাস্তব
চিত্র হয়, তবে সেটা হবে ভয়ঙ্কর।”
পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাতকে বিচারক বলেন, “পুলিশ অফিসার হিসেবে, ওই জেলার
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আপনার দায়িত্বের মধ্যে
পড়ে। কে কোন দল মত আদর্শের অনুসারী এটা বিচার করা আপনার বিবেচ্য বিষয় নয়। আপনাকে কাজে
দক্ষ হতে হবে। কথায় দক্ষ হলে চলবে না। কথায় পটু হলে চলবে না, কাজে পটু হতে হবে।”
বিচারক এই পুলিশ কর্মকর্তাকে কুষ্টিয়ায় সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত
করতে বলেন।
“আপনার কার্যক্রমের মাধ্যমে সবকিছু সমন্বয় করে আপনি সেখানে শান্তিপূর্ণ
সহাবস্থান নিশ্চিত করবেন, যাতে পুলিশ ভীতিকর না হয়, বন্ধু হয়। আপনাদের মূল মন্ত্র দুষ্টের
দমন শিষ্টের পালন। আপনাকে সে বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে।”
বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক বলেন, “আপনাদের অনেক দক্ষ পুলিশ অফিসার আছেন, যারা
অনেক সুনাম অর্জন করেছেন। আপনাকেও সে জায়গায় যেতে হবে। আপনি তো রাষ্ট্রপতির পদক পেয়েছেন।
সারা দেশে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তার নিরসন আপনাদের করতে হবে।
“আপনাদের যথেষ্ট জ্ঞান আছে, সেটা কাজে লাগান। সমাজকে একটা শান্তিপূর্ণ
সহাবস্থানের দিকে নিয়ে যান। রাষ্ট্রের এই অর্গানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে কাজ করাই
দক্ষতা। এমন যেন না হয় যে মানুষ মনে করে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গেছে।
“যশোরের অবস্থা আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে দিয়েছে। এই উৎকণ্ঠা নিরসন করা
আপনাদের দায়িত্ব।”
এরপর আদালত পুলিশ সুপারকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আগামী ১৭
ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির তারিখ রাখে।
পুলিশ কর্মকর্তা এস এম তানভীর আরাফাতের পক্ষে আদালতে ছিলেন আইনজীবী মুনসুরুল
হক চৌধুরী ও আহমেদ ইশতিয়াক।
প্রিজাইডিং কর্মকর্তার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অনীক আর হক ও ইশরাত হাসান।
আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাহেরুল ইসলাম।
আইনজীবী মনসুরুল হক আদালতে বলেন, “পুলিশ সুপার সেদিন ম্যাজিস্ট্রেটকে চিনতে
পারেননি। তাই অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে তিনি দায়িত্ব পালনে আরও সতর্ক হবেন।”
আর আইনজীবী আহমেদ ইশতিয়াক পুলিশ সুপারের লিখিত আবেদনটি আদালতে উপস্থাপন
করেন।
সেখানে তানভীর আরাফাত বলেন, “বিচার বিভাগের জন্য আমার মনে সর্বোচ্চ সম্মান
রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই বিন্দুমাত্র অসম্মান দেখানোর কথা দূরে থাক, বরং বিচার বিভাগের
দেওয়া কাজে নিয়োজিত হতে পারলে নিজেকে সম্মানিত বোধ করি। এ ঘটনায় আমি মনের গভীর থেকে
অনুতপ্ত। আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”