সোমবার ভার্চুয়াল সংবাদ
সম্মেলন করে এই দাবি জানায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই সংগঠন।
সংবাদ সম্মলনে চারটি
দাবি জানানো হয়- অবিলম্বে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ
প্রত্যাহার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ সব অভিযোগের তদন্ত
করা, অযোগ্য-দুর্নীতিবাজ উপাচার্য নিয়োগ বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় গণতন্ত্রায়ণ
ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ানো শিক্ষকদের শাস্তি দিয়ে
ভয় দেখানো বন্ধ করা।
এসব দাবিতে আগামী ২৮
জানুয়ারি বেলা ১২টায় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে শিক্ষার্থী-শিক্ষক প্রতিবাদ সমাবেশের
ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
গত বছর জানুয়ারির শুরুতে
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফি কমানো, আবাসন সংকট নিরসনসহ পাঁচ দফা দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন
করে শিক্ষার্থীরা। এর প্রায় নয় মাস পর গত ১৩ অক্টোবর ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ‘উসকানি’
দেওয়ার অভিযোগ এনে তিন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে
এ ঘটনার তদন্ত ও কয়েক দফা কারণ দর্শানোর পরও ২৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট
সভায় তিন শিক্ষকের মধ্যে একজনকে বরখাস্ত এবং দুইজনকে অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃত ওই শিক্ষক
হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল ফজল। একই বিভাগের প্রভাষক
শাকিলা আলম এবং ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরীকে অপসারণ করা
হয়।
এছাড়া আন্দোলনে সম্পৃক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মোবারক হোসেন নোমান (১৮ ব্যাচ)
এবং ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী ইমামুল ইসলামকে (১৭ ব্যাচ) বহিষ্কার করা
হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের
নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরীর সঞ্চালনায় ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে যৌথভাবে
লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী
অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক আরাফাত রহমান।
লিখিত বক্তব্যে বলা
হয়, “আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করার জন্য
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করে বর্তমান প্রশাসন তার সমস্ত স্বেচ্ছাচারিতার ইতিহাস
চাপা দিতে চেয়েছে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিস্তর দুর্নীতি এবং কতিপয় শিক্ষকের নামে যৌন
হয়রানির অভিযোগ গণমাধ্যমে উঠে আসার পর সকলের মনোযোগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য
প্রশাসন গর্হিত এ কাজটি করেছে।”
সংবাদ সম্মলনে জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “আপাত দৃষ্টিতে দুইজন
শিক্ষার্থী কিংবা তিনজন শিক্ষকের উপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আক্রমণ মনে হলেও এটি
আসলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আক্রমণ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানে সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আক্রমণ মানেই দেশের সকল নাগরিকের উপর আক্রমণ। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়
যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আচরণ করতে না পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
না থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে
তাহলে সেটি আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না।
“এতে সরকার, পদধারী
ব্যক্তি, ঠিকাদার কিংবা সন্ত্রাসীরা লাভবান হলেও এই ক্ষতির প্রভাব পড়বে দেশের সকল মানুষের
উপর। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটছে, অন্যান্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পরিস্থিতি ঘটানোর
চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ের রাজত্ব কায়েমের জন্য এই তিন শিক্ষককে বহিষ্কার
করা হয়েছে। যাতে আর কেউ কোনো প্রশ্ন বা অন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে পারে।”
এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত
প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে
দেখা যাচ্ছে, শুরুতেই তরুণ শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন একটি জাল সৃষ্টি করা হয়,
এমন একটা চাপ তৈরি করা হয়, এমন কিছু শর্ত আরোপ করা হয়, এমন একটা অসহায়ত্ব তৈরি করা
হয়, যাতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ভেতরই তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। যাদের মেরুদণ্ড আছে, তাদের
মেরুদণ্ড ভাঙার চেষ্টা করা হয়।
“নিয়োগের পর তাদের
সরকার কিংবা উপাচার্য গ্রুপের মধ্যে থাকতে বাধ্য করা হয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন
শিক্ষক সেই চাপেরই শিকার। যাতে আর কোনো তরুণ শিক্ষক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে।”
এ বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ
না নিলে গণতদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের
দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বৈরতন্ত্র, নিপীড়নমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা
গ্রহণ না করলে পরবর্তীতে শিক্ষক ও নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে একটি গণতদন্ত কমিটি গঠন করা
হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে কী হচ্ছে, তার উপর তদন্ত করে প্রতিবেদন জনগণের সামনে প্রকাশ
করা হবে।”
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, “খুলনা
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাজনীতিমুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে ছাত্রদের ধারাবাহিকতায়। কিন্তু দুঃখজনক
হলেও সত্য, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা রাজনীতি না করলেও উপাচার্য এবং তার আশপাশের
লোকজন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে রাজনৈতিক মত প্রকাশ করে থাকেন। যদি ছাত্ররা কিছু বলে, তখন
প্রশাসন ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দোহাই দিয়ে তাদের উপর নিপীড়ন চালানোর চেষ্টা
করে।”
বহিষ্কারের ঘটনাকে
‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বলা হচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১২তম
সিন্ডিকেটে শিক্ষকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়। ২১১তম সিন্ডিকেটে
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা জরুরি ভিত্তিতে আহ্বান করা হয়। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়
ধরনের কোনো সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা কিংবা জরুরি কোনো বিষয়ে জরুরি সিন্ডিকেট আহ্বান করা
হয়। তবে ২১১তম সিন্ডিকেটে ওই শিক্ষকদের কাছ থেকে মাত্র দেড় কর্মদিবসের মধ্যে উত্তর
চাওয়া হয়েছিল। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে এই সিন্ডিকেট ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের
মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান মামুন,
উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী
অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান উপস্থিত ছিলেন।