বুধবার বন্দর নগরীতে উত্তেজনার এই ভোটে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন একজন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪০ জন। আটক হয়েছেন আওয়ামী লীগের এক বিদ্রোহী ও বিএনপির এক কাউন্সিলর প্রার্থী।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সিসিসির আগের নির্বাচনেও সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের কেন্দ্র দখল ও ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগ তুলে তিন ঘণ্টার মাথায় সরে দাঁড়িয়েছিলেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলম।
এবার সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্র থেকে নিজের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ বিএনপির এবারের মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন করলেও ভোট থেকে সরেননি তিনি। তবে ভোটগ্রহণ শেষে দলটির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে, কোনো ভোটই হয়নি।
বিপরীতে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের দাবি, বিএনপির এজেন্টরা সকাল থেকেই কেন্দ্রে আসেননি। আর আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই বিএনপির এসব অভিযোগ।
চট্টগ্রামে ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশে নির্বাচনে সহিংস কিছু ঘটনা ঘটেই থাকে। সে বিচারে চট্টগ্রামে সহিংসতা কমই হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ১০ মাস বিলম্বে চট্টগ্রাম সিটির ভোট হল সেই ঝুঁকি মাথায় নিয়েই। এরমধ্যে প্রচারের সময় দুজন নিহত হন।
সবমিলিয়ে এবারের সিসিসি ভোট ঘিরে প্রাণ গেল তিনজনের।
নগরীর ৭৩৫টি কেন্দ্রে বুধবার সকাল ৮টায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এই ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে একটানা চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।
কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরোধে সংঘাত
ভোট চলাকালে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত সাতটি ওয়ার্ডে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে পাহাড়তলীতে গুলিতে একজন নিহত হন; পাথরঘাটায় ইভিএম মেশিন ভাঙচুর করার অভিযোগে বিএনপি সমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থীকে আটক করে পুলিশ।
শেষবেলায় উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর পুলিশের সঙ্গেও সংঘর্ষ হয়। সেখানে আটক এক প্রার্থীকে ছাড়া হয় ভোটগ্রহণ শেষের পর।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে দল সমর্থিত প্রার্থীদের বিরোধ নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল আগে থেকে, তার প্রতিফলন ঘটল ভোটের দিনে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪ হাজার সদস্যদের দায়িত্বে রেখে নির্বাচন কমিশনের প্রতিশ্রুতি ছিল ‘সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ ভোটের।
তবে ভোটের দিন নগরীর সব জায়গার পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকেনি।
হতাহতের ঘটনার পাশাপাশি অনিয়মের অভিযোগও তোলা হয়েছে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষ থেকে।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমবাগান এলাকায় ইউসেপ স্কুল কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।
সে সময় গুলিতে নিহত হন মো. আলাউদ্দিন আলম নামের ২৩ বছর বয়সী এক যুবক; এক নারীসহ আরও ছয়জন আহত হন।
নাস্তা করতে বেরিয়ে ভোটের সংঘাতে প্রাণ গেল আলাউদ্দিনের
চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমবাগান এলাকায় ইউসেপ স্কুল কেন্দ্রের বাইরে গুলিতে নিহত মো. আলাউদ্দিন আলমের স্বজনদের আহাজারি।
বিদ্রোহী প্রার্থী মো. মাহমুদুর রহমান নিহত আলাউদ্দিনকে নিজের সমর্থক দাবি করে দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর সমর্থকদের।
পরে ওই ঘটনার ছবি তুলতে গেলে সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদুর রহমানের অনুসারীরা সারাবাংলার অলোকচিত্রী শ্যামল নন্দীর মোটর সাইকেল ভাংচুর করে।
তবে কার গুলিতে আলাউদ্দিনের প্রাণ গেছে, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি খুলশী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আফতাব হোসেন।
এদিকে নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ডে ভোটের সকালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বিদ্রোহী প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে আহত হয়েছেন অন্তত ২১ জন।
বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল হালিম শাহ আলম অভিযোগ করেছেন, ওই ওয়ার্ডের ১৪টি কেন্দ্রের মধ্যে সবগুলো ‘দখল’ করে নেয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মীরা।
আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবুল হাসনাত বেলালের দাবি, তার অনুসারীদের উপর হামলা হয়েছে বিএনপি প্রার্থীর নেতৃত্বে।
এ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর এফ কবির মানিক। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত হত্যা মামলার আসামি দিদারুল আলম মাসুম দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
চট্টগ্রাম সিটি ভোটের দিন সকালে নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সকাল ৯টার দিকে শহীদ নগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে বেলালের সমর্থকদের সঙ্গে মাসুমের সমর্থকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
আর পুলিশ লাইন কেন্দ্র, মাস কিন্ডারগার্টেন কেন্দ্রেও বিএনপি প্রার্থীর সমর্থকরা হামলা চালায় বলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল হাসনাত বেলাল অভিযোগ করেন।
অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবদুল হালিম শাহ আলম বলেন, “কোনো কেন্দ্রেই মেয়র ও আমার এজেন্ট ঢুকাতে পারেনি। তারা আমাকেও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। আমাদের ১৫ জন আহত হয়েছে।”
খুলশী থানার ওসি শাহিনুজ্জামান বলেন, কেন্দ্রের বাইরে দু’পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছিল। পুলিশ-বিজিবি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে।
সংরক্ষিত-৫ ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলর প্রার্থী মনোয়ারা বেগম মনি বলেন, লালখান বাজার ওয়ার্ডসহ তিনটি ওয়ার্ডের মোট ৪৪ কেন্দ্রে তার ৩২০ জন এজেন্টের কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
“সকাল থেকে তিন দফায় আমার বাসায় আওয়ামী লীগের লোকজন হামলা করেছে। লালখান বাজার ওয়ার্ড অফিস কেন্দ্রে আমি ভোটার। সেখানেও আমাকে ঢুকতে দেয়নি।”
এদিকে নগরীর ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ইসমাইল বালিকে দুপুরে আটক করে পুলিশ।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মেহেদী হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ইভিএম মেশিন ভাঙচুর ও নির্বাচনী সহিংসতার অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছে।”
সহিংসতা: চট্টগ্রামে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলরপ্রার্থী আটক
বেলা ১১টার পর ব্রিক ফিল্ড রোডে পাথরঘাটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
ওই কেন্দ্রের চারটি বুথের একটিকে ইভিএম মেশিন ভাঙচুর করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে পরে সেখানে ভোটগ্রহণ চালিয়ে নেওয়া হয়।
ওই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী পুলক খাস্তগীর। এছাড়াও আওয়ামী লীগে যুক্ত বিজয় কৃষ্ণ দাশ ও অনুপ বিশ্বাস ওই ওয়ার্ডে প্রার্থী হন।
ভোটগ্রহণের মধ্যে বিকেলে বন্দর নগরীর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর আটক এবং এক কর্মীর মৃত্যুর গুজবে ফিরোজ শাহ এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ বাঁধে।
উত্তর পাহাড়তলী উত্তপ্ত করল কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিবাদ
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল আবছার মিয়া এবং বিদ্রোহী প্রার্থী বিদায়ী কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম।
স্থানীয়রা জানান, দুপুর থেকেই আকবর শাহ থানার ফিরোজ শাহ কলোনি ও বিশ্ব কলোনি এলাকায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। বিকালে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর অনুসারী এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আবছার মিয়ার দাবি, তার কর্মীদের উপর হামলা হয়েছে। পরে পুলিশ এসে জহুরুল আলম জসিমকে ধরে নিয়ে যায়।
সংঘর্ষের পর একজন নিহত হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এতে আবার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয় ফিরোজ শাহ কলোনি এলাকায়।
এক পর্যায়ে বিকেল ৩টার দিকে আকবর শাহ থানার সেভেন মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের পর বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী জহুরুল আলম জসীমকে আটক করা হয়।
ওই খবর ছড়িয়ে পড়লে জসিমের অনুসারীরা ফিরোজ শাহ কলোনি থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে। কলোনির গেট আটকে এবং সড়কে বিভিন্ন সরঞ্জাম ফেলে বন্ধ করে দেয়।
এসময় বিক্ষোভকারীরা সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সংবাদকর্মীদেরও গতিরোধ করে, গাড়ি ভাংচুরের চেষ্টা চালায়। ভাংচুর করা হয় পুলিশ বহনকারী একটি মাইক্রোবাসও।
এছাড়া ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের কর্নেল হাট মোড় এবং মুন্সিপাড়া এলাকায় কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ককটেল বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে।
৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর এবং ৪ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডেও কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনুসারীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
বিএনপির অভিযোগ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলায় ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে তাদের কাউন্সিলর প্রার্থী এস এম ফরিদুল আলমের হাত ভেঙেছে এবং সংরক্ষিত নারী আসন-৪ এর কাউন্সিলর প্রার্থী সখিনা বেগমের মাথা ফেটেছে।
বিএনপির এজেন্ট নেই, বুথে ‘সহায়তাকারী’
ভোটের সকালে নগরীর জামালখান, এনায়েতবাজার, আন্দরকিল্লা, পশ্চিম বাকলিয়া, লালখান বাজার, পাঠানটুলি, আগ্রাবাদ, পাথরঘাটা ওয়ার্ডের বেশ কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে বিএনপির এজেন্টদের দেখা মেলেনি।
দুয়েকটি কেন্দ্রে যেখানে পাঁচের বেশি বুথ ছিল, তার মধ্যে ধানের শীষের দুয়েকজন এজেন্টকে দেখা গেছে।
চট্টগ্রামের ভোটচিত্র: অনেক কেন্দ্রে নেই বিএনপির এজেন্ট
বিএনপির প্রার্থীরা তাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ করলেও দায়িত্বরত প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা বলেছেন, বিএনপির প্রার্থীদের এজেন্টরা ‘আসেননি’।
সকাল সাড়ে ১০টায় নগরীর ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ একাডেমিক ভবন-১ এ ভোট দেওয়ার পর বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন ভোটের পরিবেশ নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের ‘বের করে দেওয়া’ হয়েছে, এমনকি এজেন্টদের ‘মারধর’ এবং ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে ‘না দেওয়ার’ অভিযোগও তিনি পেয়েছেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বুধবার সকালে নগরীর ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী শাহাদাত হোসেন।
এত অভিযোগের পরও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকছেন কিনা জানতে চাইলে শাহাদাত বলেন, “আমি একজন মাঠের রাজনীতিবিদ। ছাত্র রাজনীতি করে উঠে এসেছি। চট্টগ্রামেই আমার বাস। আমি অন্য জায়গা থেকে উড়ে আসিনি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকব, আওয়ামী ভোট ডাকাতির মুখোশ উন্মোচন করব।”
ভোটই তো হয়নি, প্রতিক্রিয়া আমীর খসরুর
‘ভোট ডাকাতির’ মুখোশ উন্মোচনে শেষ পর্যন্ত থাকব: শাহাদাত
ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপির ‘পরিকল্পিত হামলা’: আওয়ামী লীগ
ওই কেন্দ্রে সাদিয়া বেগম ঝিনু নামের এক নারী ভোটার বলেন, “কেন্দ্রে প্রবেশের পর দেখি বুথের মধ্যে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভোট দেওয়ার আগেই সেই ব্যক্তি আমার ভোটটি দিয়ে দেয়।”
লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিস কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে একই পরিস্থিতির মুখে পড়েন আরেক নারী ভোটার।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বুধবার সকালে বহদ্দারহাট এখলাছুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী।
সকাল ১০টায় লালখান বাজারের শহীদ নগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে বিএনপির কোনো এজেন্ট পাওয়া যায়নি।
কেন্দ্রটির ৪ ও ৫ নম্বর ভোটকক্ষের সামনে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। তবে তারা কেউ ভোট দিতে যাচ্ছিলেন না। তাদের সবার গলায় নৌকা প্রতীকের কার্ড ঝোলানো ছিল।
কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বশির আহমেদ বলেন, “বাইরে সমস্যা ছিল, তবে কেন্দ্রের অভ্যন্তরে সমস্যা নেই।”
ভোটার নেই, অথচ লাইনে দলীয় সমর্থক কেন- জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
ভোটার উপস্থিতি কম
বেশিরভাগ কেন্দ্রে দেখা যায়, বাইরে বিপুল লোকজন থাকলেও ভেতরে ভোটার উপস্থিতি কম।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত সোমবার থেকেই অভিযোগ করছিলেন, আশেপাশের উপজেলা ও বিভিন্ন জেলা থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের জড়ো করেছে ভোট কেন্দ্র দখলে নিতে।
বুধবার বিভিন্ন কেন্দ্রের বাইরে তরুণ-যুবকদের দিনভর অবস্থান নিয়ে থাকতে দেখা গেছে।
এনায়েত বাজার ওয়ার্ডের এবাদুল্লাহ পন্ডিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটার সুজন ঘোষ বলেন, “ভোট দিতে গেলেই জোর করেই নৌকা ও ঘুড়ি মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা।”
সকাল পৌনে ৮টায় গিয়ে দেখা যায়, ওই কেন্দ্রের বাইরে ১১ জন ভোটার সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
সেসময় দ্বিতীয় তলা থেকে ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দিতে দেখা যায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের। বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টরা কাছের এনায়েত বাজার মোড়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর চলে যায়।
দুপুরে ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গি বাজার ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার জেএম সেন স্কুল কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মো. সালাউদ্দিনের অনুসারীরা অবস্থান নিয়ে আছে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধাওয়া দেয়।
একই ওয়ার্ডের আলকরণ বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিদ্রোহী প্রার্থী হাসান মুরাদ বিপ্লবের অনুসারীরা অবস্থান নেয়।
পাঠানটুলি খান সাহেব বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৫১৮ জন। সকাল ১০টা নাগাদ সেখানে ৯৭টি ভোটগ্রহণ হয় বলে জানিয়েছিলেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বিষ্ণুপদ শীল। ওই কেন্দ্রে বুথ সংখ্যা সাতটি।
প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বলেন, “নারী ভোটার হওয়ায় তারা ধীরে ভোট কেন্দ্রে আসছেন।”
গোসালাইডাঙ্গা রামকৃষ্ণ স্কুল কেন্দ্রে মোট ভোটার ২০৩৭। বুথ সংখ্যা ৫টি। সকাল ১০টা পর্যন্ত সেখানে ভোট দিয়েছিলেন ৬৫ জন। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা জাফর আহমদ বলেন, “ভোটাররা কর্মজীবী হওয়ায় উপস্থিতি কম।”
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লালখান বাজার বার্থ কিন্ডারগার্টেন স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিচ্ছেন এক নারী। ছবি: সুমন বাবু
বারিক মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১৫৬৫ জন ভোটারের মধ্যে দুই ঘণ্টায় ভোট দেন ২০০ জন। পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১৮৮৪ জন ভোটারের মধ্যে দুই ঘণ্টায় ভোট দেন ১৩৫ জন।
ব্যতিক্রম দেখা গেছে ৩৪ নং পাথরঘাটা ওয়ার্ডে নিমন্ত্রণ ক্লাবের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে। সেখানে দুপুর ২টায় দেখা গেছে, ভোটগ্রহণ চলছে সুষ্ঠুভাবে। সব প্রার্থীর এজেন্টও রয়েছে।
ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান শাহী বলেন, “২৭৫৩ ভোট আছে । এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ ভোট হয়েছে ইতিমধ্যে। এখানের পরিবেশ খুবই ভালো।”
নগরীর জামালখান ওয়ার্ডের কুসুমকুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সারিবদ্ধভাবে নারীদের ভোট দিতে দেখা যায় বেলা পৌনে ২টায়। কয়েকজন নারী ভোটার জানান, তারা নিজেদের ভোট নিজেরা দিয়েছেন। কোনো সমস্যা হয়নি।
এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। তাদের ভোটেই সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র, ৩৯ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ১৪ জন নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন।
নির্বাচনে মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী থাকলেও বরাবরের মতোই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের মধ্যে।
নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্র থেকে ফলাফল এলে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়ামে রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে তা ঘোষণা করা হবে। ইভিএমে ভোট হওয়ায় ফলাফলের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার প্রয়োজন হবে না।