ক্যাটাগরি

শহরতলীতে ‘রস উৎসব’

পৌষ বা মাঘে ভোরের
আলো ফোটার সঙ্গে আড়মোড়া ভেঙে ততক্ষণে জেগে ওঠে গ্রাম; দুয়ারে আসা গাছির কলসি থেকে মাটির
ভাড়ে করে টাটকা রস ঘোরে হাতে হাতে।

খেজুরের রসের সঙ্গে
উনুন থেকে সদ্য উঠে আসা খই, মুড়ির সঙ্গে গুড়ে সকালের প্রাতঃরাশ সেরে নেয় গ্রামবাসী।

গ্রামবাংলার লোকজ জীবনের
সঙ্গে নগর জীবনের যোগসূত্র রচনায় ‘রঙ্গে ভরা বঙ্গ’ সংগঠনের পক্ষ থেকে দশমবারের মতো
আয়োজিত হল রস উৎসব।

শুক্রবার সকাল ৮টা
থেকে শুরু হয়ে বেলা সাড়ে ১০টা অবধি চলে রস উৎসবের আয়োজন। বাউল আলী হোসেন ভাণ্ডারি ও
তার দলের লোকজ গানের সঙ্গে মুড়ি-মুড়কি, গুড় আর রসের আয়োজন ছিল পুরোটা সময়জুড়ে।

এর আগের নয়টি উৎসব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় হলেও এবার উৎসবের স্থান পরিবর্তন করতে
হয়েছে আয়োজকদের। এবার রস উৎসবের আসর বসেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭০ নম্বর ওয়ার্ড,
ডেমরার রাজাখালী ঘাটের সুধারাম বাউলের আশ্রমে।

রস উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা
সাবিহা সুলতানা জানান, “করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
এবারও খোলেনি। আমরা চাইনি, আয়োজনটি এক বছরের জন্যও বন্ধ থাক।

“শহর থেকে একটু দূরে
হলেও একদম নদীর পাড়ে, প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুরার গ্রামীণ আবহে রস উৎসব দেখছে, তারা
জানছে গাছিরা কিভাবে রস নামিয়ে আনে, এখানেও ভিন্নতা রয়েছে।”

রস উৎসবে বরাবরেই মতোই
নগর জীবনে লোকজ তৈজসপত্রের ব্যবহারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

উৎসব সমন্বয়কদের একজন
ইমরান-উজ-জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রসের মেলায় আমরা নগরবাসীকে লোকজ
জীবনে ব্যবহৃত নানা তৈজসপত্র ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে থাকি। মাটির গ্লাস, সানকি, কলসি
নিত্য প্রয়োজনীয় এমন অনেক তৈজসপত্র কিন্তু আমাদের আশপাশেই আছে। চিকিৎসকরা বলছেন, প্লাস্টিক
পণ্য থেকে সরে এসে মাটির পণ্য ব্যবহারের গুণাগুণের কথা।

“স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনাতেও
আমাদের লোকজীবনে ফিরে যাওয়া খুব জরুরি। আমরা এমন উৎসবের মাধ্যমে লোকজীবনটাই এই শহরে
ছড়িয়ে দিতে চাই।”

রস উৎসবে যোগ দিয়ে
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের অধ্যাপক আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এখানে এসে
মনে হচ্ছে, ঢাকায় থেকে বুকটা যে ভার ভার লাগে ওই জিনিসটা সরে গেছে। শহর থেকে একটু দূরে,
নদীর ধারে এই আয়োজনে বাংলা ঐতিহ্যের স্বাদটা খুঁজে পাই। বাংলা ঐতিহ্যের যে স্বাদ তা
কিন্তু দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

“আগে প্রচুর খেঁজুর
গাছ ছিল। রসের গাছ অনেক জায়গায় নেই এখন। অট্টালিকা হচ্ছে। তবুও যা কিছু গাছ আছে, তার
থেকে রস সংগ্রহ করে এই রস উৎসবের আয়োজন করছে। শহর থেকে দূরে বলে জনসমাগম হয়ত একটু কম।
কিন্তু এখানে এসে যে গ্রামীণ লোকজ জীবনের ঘ্রাণ পেলাম, তাই অসাধারণ।”

দিনাজপুরের মেয়ে মেহনাজ
মুন্নী পড়াশোনার সুবাদে থাকেন ঢাকায়। রস উৎসবে এসে তিনি শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করেন।

“আমাদের বেড়ে উঠার
সঙ্গে এই রস উৎসব ছিল আমাদের দৈনন্দিন সংস্কৃতিরই একটা অংশ। শীত এলে খেঁজুরের রস আসত,
খেঁজুর গুড়ে নানা পিঠা-পায়েস খেতাম। কিন্তু শহরে আসার পর দিন দিন তা হারিয়ে ফেলছি আমরা।

“বেশ কয়েকবার এই রস
মেলায় এসেছি। এখানে এসে লোকজ ব্যাপারগুলো নিয়ে আরও ভালো করে জানতে পারছি। আমরা যেন
আমরা গ্রামীন ঐতিহ্যকে ধারণ করে থাকতে পারি, সেটাই চাই আমরা।”

লোকজ তৈজস ব্যবহারে
গুরুত্বারোপ করেন বাউল শিল্পী আলী হোসেন ভাণ্ডারি।

“আগে আমরা মাটির সানকিতে
করে ভাত খেতাম। এই তো সেদিনের কথা। কিন্তু এখন সব পলিথিন, প্লাস্টিকে ছেয়ে গেছে। পাটের
সুতায় তৈরি ব্যাগ নিয়ে বাজারে যেতাম। কিন্তু সেসব আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

“এখন আমরা যদি আবার
সেই দিনগুলো ফিরে যাই, তাহলে সেটা পরিবেশের জন্যই ভালো।”