ক্যাটাগরি

ফল প্রকাশে খুশি, ‘অটোপাসে’ খুঁতখুঁত

অনেক শিক্ষার্থী আশানুরূপ ফল পাননি, অনেকেই পেয়েছেন আশাতীত ফল। বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকেরা নিজেদের অনুভূতি ও মতামত তুলে ধরেছেন।

ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ফাইয়াজ ইফতি জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন; এইচএসিতেও জিপিএ ৫ পেয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলল, “এটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে আমরা ক্যাম্পাসে গিয়ে এক সাথে উল্লাস করতে পারছি না, বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পারছি না, এখানে একটা অতৃপ্তি কাজ করছে।”

ইফতির বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, “মহামারী সবকিছু উলট-পালট করে দিয়েছে- এই বিবেচনায় সরকার এবার পরীক্ষা ছাড়াই রেজাল্ট দিয়েছে, এটা আমরা স্বাগত জানাই। কারণ এটা করা ছাড়া উপায় ছিল না।

“এখন মেডিকেলে অ্যাডমিশনের জন্য ছেলেটা অনলাইনে কোচিং করছে। জানি না, এত এত এ প্লাসের ভিড়ে সে নিজের জায়গাটা তৈরি করে নিতে পারবে কিনা। এইচএসসিতে তো আর মেধা যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না।”

নিজের ফলে সন্তুষ্ট হলেও পরীক্ষা না হওয়ায় এইচএসসিতে পড়াশোনার মূল্যায়নে যে ঘাটতি থেকে গেল তা নিয়ে কিছুটা অতৃপ্ত হলিক্রস কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী মাইশা মরিয়ম। 

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট অর্জনের চেয়ে আনন্দের আসলে কিছু হয় না। এতে রেজাল্টের কৃতিত্বটা আমারই থাকত, কেউ কিছু বলার সুযোগ পেত না।”

ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মইনুল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুধু বাংলাদেশই না পৃথিবীর আরোও অনেক দেশেও এভাবেই বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন করা হয়েছে। মানুষের জীবনের মূল্য সবচেয়ে বেশি। বেঁচে থাকলে পরীক্ষা দেওয়া যাবে।”

প্রত্যাশিত ফল পেলেও ‘অটোপ্রমোশন’ নিয়ে অতৃপ্তি আছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ছাত্রী সামিনা নূরেরও।

তার ভাষ্য, “রেজাল্ট তো পেয়েছি প্রত্যাশা মতোই। কিন্তু পরীক্ষাটা হলে আমাদের অটোপাসের তকমাটা থাকত না। এখন তো সারাজীবনই শুনতে হবে, ‘ও তুমি তো অটোপাস’।”

করোনাভাইরাস মহামারী কারণে কলেজে গিয়ে এইচএসসির পরীক্ষার ফলাফল সংগ্রহে বারণ থাকায় শনিবার অনলাইনে ফলাফল দেখে শিক্ষার্থীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

করোনাভাইরাস মহামারী কারণে কলেজে গিয়ে এইচএসসির পরীক্ষার ফলাফল সংগ্রহে বারণ থাকায় শনিবার অনলাইনে ফলাফল দেখে শিক্ষার্থীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

তবে মহামারীর কারণে এবার ঘোষিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য না করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে তা স্থগিত করা হয়।

মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ায় গত অক্টোবর সরকার জানায়, পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনীর মতো এইচএসসি পরীক্ষাও নেওয়া যাচ্ছে না।

এরপর আইন সংশোধন করে পরীক্ষা ছাড়াই মূল্যায়নের পথ বের করে এই ফল দেওয়া হল।

‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ করে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণা করায় আগের দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেও এবার ৩৯৬ জন পূর্ণাঙ্গ জিপিএ-৫ পায় পাননি।

আবার জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেলেও এবারের ফলাফলে ১৭ হাজার ৪৩ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।

ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এরকম মহামারীর মধ্যে এর বিকল্প আর কি ছিল?”

তবে পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে নিজের ফল নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী ফারিয়া।

তিনি বলেন, “অনেকেই ‘অটোপাশ’ নিয়ে আপত্তি করলেও করোনাকালীন পরিস্থিতিতে এটাই উত্তম বলে মনে হয়েছে। যদিও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারলে একটা মানসিক স্বস্তি কাজ করতো”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। ছবি: পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। ছবি: পিআইডি

এইচএসসির জন্য যেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, তার সাহায্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াই এখন তার লক্ষ্য বলে জানান তিনি।

এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস না থাকায় চিন্তায় এইচএসসির ফল নিয়ে চিন্তায় ছিলেন কুর্মিটোলা বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার রুমি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কিন্তু ফলাফল দেওয়ার পর দেখলাম এ প্লাস এসেছে। তাই আমি খুব খুশি। তবে দুই বছরের পড়াশোনা এবং চেষ্টার মূল্যায়ন নিয়ে আমি নিজেও খানিকটা অসন্তুষ্ট।

“কারণ এই দুই বছর কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছি, সেটা আমি আর আমার পরিবার জানে। যাই হোক, মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে আশা করি এই পরিশ্রম কাজে দেবে।”

মিরপুর কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ সফিক মাহমুদের মা আশেয়া আক্তার ছেলের ফলাফলে সন্তুষ্ট না হলেও ফলাফল মেনে নিয়েছেন।

তিনি বলেন, “পরীক্ষা হলে হয়ত আরো ভাল রেজাল্ট করতে পারত। কিন্তু যে পরিস্থিতি তাতে তো পরীক্ষা নেওয়াও সম্ভব ছিল না। তবে কেউ যেন ছেলেমেয়েদের অটোপাস না বলে, অভিভাবক হিসেবে এটা আমার অনুরোধ।”

ফলাফলের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে দুপুরে হলিক্রস কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার শিখা গোমেজের সাথে যোগাযোগ করা হলে, এখনো ফলাফল পাননি বলে জানান তিনি।

অটোপ্রমোশনের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি রেজাল্টটা না দেখে কথা বলতে পারছি না।”

ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীরাও ফলাফল নিয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন।

এ প্লাস পাবেন এবিষয়ে অনেকটা নিশ্চিত ছিলেন কুমিল্লার জুরানপুর আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী মেহের নিগার বিথি, পেয়েছেনও।

তিনি বলেন, “তাই রেজাল্টের দিন তেমন উচ্ছ্বাস নেই। তাছাড়া পরীক্ষা ছাড়া এই অর্জন, তেমন আনন্দ দিচ্ছে না।”

এদিকে জেএসসি-এসএসসি পরীক্ষায় যাদের ফলাফল ভালো ছিল না, পরীক্ষা ছাড়া এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তাদের সবার অসন্তুষ্টি রয়েছে।

রংপুরের বদরগঞ্জের কুতুবপুর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী নয়ন হোসেন বলেন, “এসএইচসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হওয়ার জন্য কলেজে ভর্তির শুরু থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। কিন্তু এইচএসসিতে আর ভালো রেজাল্ট সম্ভব হলো না। জানি না ভবিষ্যত কোন পথে।”

পাবনা সরকারি মহিলা কলেজের পরীক্ষার্থী ফারিয়া তাবাসসুম তুলি বলেন, “পরীক্ষা ছাড়াই পাশ করেছি, ভালো রেজাল্ট করেছি, এটা নিজেকে স্বস্তি দিচ্ছে। কিন্তু অটোপাশের বিষয়টা সমাজ কীভাবে নেবে, সেটা নিয়ে উদ্বেগ আছে।”

ওই শিক্ষার্থীর অভিাবক নুরুন্নাহার পলি বলেন, “করোনায় পরীক্ষা নেওয়া যেমন কঠিন ছিল, তেমনি পরীক্ষা বা মূল্যায়ন না করে অটোপাশ দেওয়াটাও ক্ষতিকর। অটোপাশের মাধ্যমে মনোযোগী-অমনোযোগী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তফাৎ থাকল না। যারা মনোযোগী ছাত্র-ছাত্রী ছিল, তারা রেজাল্ট ভালো হলেও অটোপাশের শিক্ষার্থী বলে সমাজে বিদ্রুপের শিকার হতে পারে।

“আবার যারা পড়াশোনা করেনি তারাও মূল্যায়ন ছাড়া এগিয়ে গেল, যা ভবিষ্যতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আবার করোনা পরিস্থিতিও একটি বিবেচ্য বিষয়। অনার্স বা উচ্চ-শিক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়ন করে এডমিশন হলে এ ক্ষতি হয়ত কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া যাবে।”