এই অভিযোগ তুলে তার তদন্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল
গঠনের আরজি জানিয়ে গত বছর ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে তারা একটি চিঠি
পাঠিয়েছিলেন।
এরপর ১৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় চিঠিটি পাঠানো হয় বলে রোববার
জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, যিনি এক সময় নির্বাচন কমিশনের
কৌঁসুলি ছিলেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহামান্য
রাষ্ট্রপতিকে এই চিঠিটা আমরা পাঠিয়েছি গত ১৭ জানুয়ারি। আজকে আপনাদের সেটা জানিয়েছি।”
এবারের চিঠিটি কেন দিয়েছেন- জানতে চাইলে শাহদীন মালিক
বলেন, “প্রশিক্ষণ দেওয়ার নামে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি আগেও চিঠিতে আমরা উল্লেখ
করেছিলাম।
“এ বিষয়টা নিয়ে বৈশাখী টেলিভিশন সাত পর্বের একটি সিরিজ
করেছিল। ওই সাত পর্বের প্রতিবেদনের সিডি ও মহা হিসাব নিরীক্ষকের অডিট আপত্তি এবার
যুক্ত করে চিঠিটি পাঠিয়েছি।”
প্রথম চিঠি পাঠানোর প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন
কমিশনার কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “ইসিকে দায়ী
করে যে বক্তব্য দেওয়া
হয়েছে তা অনভিপ্রেত ও
আদৌ গ্রহণযোগ্য নেয়।”
ইসির ‘গুরুতর অসদাচরণ’, রাষ্ট্রপতিকে চিঠি ৪২ নাগরিকের
বিশিষ্টজনদের অভিযোগ ভিত্তিহীন: ইসি শাহাদাত
চিঠিতে স্বাক্ষরকারী ৪২ নাগরিকের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিভিন্ন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে
আসা অবসরপ্রাপ্ত সচিব আকবর আলি খান, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, অবসরপ্রাপ্ত
মহা হিসাব-নিরীক্ষক এম হাফিজউদ্দিন খান, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, শিক্ষাবিদ
রাশেদা কে চৌধুরী।
চিঠিতে আর যারা সই করেছেন, তারা হলেন- সাবেক
মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী
খুশি কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুজন সম্পাদক
বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক
তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, শাহদীন মালিক,
আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ,
অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান,
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল
হুদা, অধ্যাপক সি আর আবরার, আইনজীবী সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক
স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তুজা, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, সুপ্রিম কোর্টের
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্লিনিকাল নিউরোসাইন্স সেন্টার, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী
ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী
জাকির হোসেন এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
তাদের চিঠিটি বাহকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে
সরাসরি পাঠানো হয়েছে বলে জানান শাহদীন মালিক।
তিনি বলেন, “কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণ করার ক্ষমতা
আমাদের নাই। ওইটা করতে পারে একমাত্র সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, অথবা দুদক।
প্রমাণ করার জন্য যে আইনি ক্ষমতা দরকার সেটা তো আমাদের নেই। ফলে আমরা যদ্দূর
বিষয়গুলো জেনেছি, মাহামান্য রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যাদের ক্ষমতা আছে এসব
অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করবার তাদেরকে দিয়ে যেন রাষ্ট্রপতি তদন্ত করান।”
এবারের চিঠিতে বলা হয়েছে, “আমরা কয়েকজন নাগরিক গত ১৪
ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে আপনার কাছে বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম
জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে জনাব কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান নির্বাচন
কমিশনের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থসংশ্লিষ্ট
গুরুতর অসদাচরণ এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অনিয়ম ও অন্যান্য গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগের
তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সবিনয় আবেদন জানাই। আমাদের অভিযোগের সপক্ষে
অতিরিক্ত কিছু তথ্য আপনার দৃষ্টিগোচর করার জন্য আবারও এই আবেদন।”
চিঠিতে বৈশাখী টেলিভিশনের ওই প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপও
তুলে ধরে বলা হয়, “দীর্ঘ ৯ মাসের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন
কমিশনের অধীনস্থ ইলেক্টরাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের ভয়াবহ দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম
সম্পর্কে ২০১৯ সালে বৈশাখী টেলিভিশনে ৭ পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রচারিত
হয়।
“প্রতিবেদনে বিশেষ বক্তা, কোর্স উপদেষ্টা, কোর্স
পরিচালক, কোর্স সমন্বয়ক, সহকারী সমন্বয়কসহ ‘বিতর্কিত’ ১৫টি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে
মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্য চারজন কমিশনার, সচিব ও ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের
মহাপরিচালকসহ কিছু উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে অন্যায় ও অনৈতিক আর্থিক সুবিধা দেওয়ার
অভিযোগ উত্থাপিত হয়। প্রতিবেদনে ২০১৮-১৯ সালে অল্প কিছু কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ
বাজেটের অন্তত ১১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও
অভিযোগ করা হয় যে, এর মধ্যে অন্তত সাড়ে তিন কোটি টাকা নিয়েছেন প্রধান নির্বাচন
কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারগণ, নির্বাচন কমিশনের সচিব, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের
প্রধানসহ মাত্র ১৮ জন কর্মকর্তা।”
নির্বাচন ভবন
বৈশাখী টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী,
বর্তমান কে এম নূরুল হুদা কমিশনের অধীনেই প্রথমবার এসব ‘বিতর্কিত’ পদ সৃষ্টির
মাধ্যমে অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়া হয়। ইসির সচিব নিজের অফিসিয়াল সচিব পদবীর
বাইরে অন্য চারটি পদ থেকে -বিশেষ বক্তা, কোর্স উপদেষ্টা, সুপারভাইজিং প্রশিক্ষক ও
প্রশিক্ষক ‘ব্যাপক আর্থিক সুবিধা’ নিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, “বৈশাখী টেলিভিশনের ধারাবাহিক
প্রতিবেদনে অর্থ লোপাটের আরও অনেকগুলো ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ উঠে, যাতে ইসির সকল
স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত ছিলেন।
“যেমন, অনুসন্ধানে কেনাকাটার রসিদের ঠিকানায় উল্লেখিত রেস্টুরেন্ট
ও দোকান পাওয়া যায়নি। আনুষঙ্গিক ও বিবিধ খাতে বিরাট অঙ্কের টাকা
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যয় করেন।
“এভাবে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন এক ভয়াবহ লুটপাটের
আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যা অতীতের কোনো কমিশনের বিরুদ্ধে উঠেছে বলে
আমাদের জানা নেই। বস্তুত সিইসি এবং অন্যান্য কমিশনারগণ এ ধরনের পরিকল্পিত লুটপাটের
শুধু অনুমোদনই দেননি, তারা নিজেরাও বিশেষ বক্তা হিসেবে এর ভাগীদার হয়েছেন।”
“এসব অর্থ লোপাটের অভিযোগ এবং এ সম্পর্কে অডিট আপত্তির
বিষয় নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে অনেকগুলো প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
প্রকাশিত হয়েছে। এসব আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির দায় নির্বাচন কমিশনেরই, কারণ
কমিশনের অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণেই এসব অর্থ ব্যয় করা হয়েছে,” বলা হয় চিঠিতে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে রাষ্ট্রপতিকে আরজি জানিয়ে
চিঠিতে বলা হয়, “এই অভিযোগ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় নথি, রেকর্ড ও দলিল, প্রদেয়
অর্থ ও অর্থ গ্রহণসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সকল লিখিত প্রমাণাদি নির্বাচন কমিশন এবং
অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তলব করতে পারে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী
একমাত্র সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল।”