এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশে হ্যান্ডসেট সংযোজন কারখানাগুলোতে স্মার্টফোন চাহিদার প্রায় শতভাগ পূরণ হচ্ছে। আর ফিচার ফোনের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ মেটাতে পারছে দেশি কারখানাগুলো।
স্যামসাংসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল সংযোজন কারখানাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরেই দেশের চাহিদার শতভাগ মেটাতে সক্ষম হবে এ খাত।
দেশে মোবাইল ফোন সংযোজন শুরু হওয়ার পর অবৈধ ও নকল মোবাইল সেট বাজারে প্রভাব পড়েছে এবং এতে ‘গ্রে মার্কেট’ও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত দেড় বছরে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরি হয়েছে ৩ কোটি ৩৮ লাখ। এর মধ্যে গত ৬ মাসে প্রায় এক কোটি ৮৮ লাখ হ্যান্ডসেট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে স্মার্টফোনের চাহিদার পুরোটাই দেশীয় কারখানাগুলোতে সংযোজন হচ্ছে।
এছাড়া গত দেড় বছরে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানি হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ। তার মধ্যে গত ৬ মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ১৮ লাখ হ্যান্ডসেট। ২০১৭ সালে দেশে হ্যান্ডসেট সংযোজন শুরু হওয়ার আগে চাহিদার পুরোটাই আমদানি করা হত।
এখন সেখানে সেটের বদলে যন্ত্রাংশ আমদানি করে কারখানাগুলোতে সেগুলো সংযোজন করে সেট তৈরি করা হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি হ্যান্ডসেটের বাজার রয়েছে। হ্যান্ডসেট আমদানিতে সব মিলিয়ে ৬০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হয়। স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল টেলিফোন সেট উৎপাদনের ওপর মূসক অব্যাহতি এবং সংযোজন খাতে ৫ শতাংশ হারে মূসক রয়েছে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির হিসাবে বর্তমানে ১২টি প্রতিষ্ঠানের মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনের লাইসেন্স রয়েছে।
এগুলো হল- ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স (স্যামসাং), এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ (সিম্ফনি), আলামিন অ্যান্ড ব্রাদার্স (৫ স্টার), কার্লকেয়ার টেকনোলজি বিডি লিমিটেড (আইটেল ও টেকনা), আনিরা ইন্টারন্যাশনাল (ইউনস্টার), বেস্ট টাইকুল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (ভিবো), গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন (লাভা), বাংলাট্রিনিক টেকনোলজি (ডিটিসি), বেনলি ইলেকট্রনিক এন্টারপ্রাইজ (অপো), ওকে মোবাইল ও মাইসেল টেকনোলজি।
মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদশে মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া শাহিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে প্রতি বছর ফিচার ও স্মার্টফোন নিয়ে ৩ কোটি ৫০ লাখের বেশি হ্যান্ডসেটের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে এক কোটি ১০ লাখের মতো স্মার্টফোনের চাহিদা রয়েছে, তা বর্তমানে পুরোটাই বাংলাদেশে তৈরি বা সংযোজন হচ্ছে। ফিচার ফোনের ৬০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশে তৈরি বা সংযোজন হচ্ছে, যা চলতি বছরের মধ্যে শতভাগে পৌঁছাবে বলে আশা করি।”
দেশে মোবাইল সংযোজন শুরু হওয়ার পরপরই অবৈধ বা নকল হ্যান্ডসেটের আমদানি কমতে শুরু করেছে জানিয়ে এডিসন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকারিয়া বলেন, “দেশে হ্যান্ডসেট তৈরি হওয়ায় বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ খরচ কম পড়ছে। তাই গ্রে মার্কেট তেমন একটা সুবিধা করতে পারছে না।”
আগামী ১ জুলাই থেকে দেশে অবৈধ ও নকল হ্যান্ডসেট বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করার পর অবৈধ হ্যান্ডসেটের বাজার পুরোটাই বন্ধ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
১২টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত মোবাইল সংযোজন কারখানার মধ্যে দুটি বাদে প্রায় সবাই উৎপাদনে রয়েছে জানিয়ে জাকারিয়া শাহিদ বলেন, আরও কয়েকটি কোম্পানি দেশে কারখানা তৈরির বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাদের কারখানা স্থাপনে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
স্যামসাং পণ্যের বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান এবং স্যামসাং লোকাল অ্যাসেম্বলি পার্টনার ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “বর্তমানে স্যামসাং মোবাইল ফোনের চাহিদার প্রায় শতভাগ পূরণ করা যাচ্ছে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে সংযোজন করা হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে। স্যামসাং ‘হাই-এন্ড ডিভাইস’ যেমন গ্যালাক্সি এস২১ আলট্রা ফাইভ-জি সংযোজন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামীতে দেশে ফাইভ-জি আসছে, এসব হ্যান্ডসেট সংযোজন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।”
স্যামসাং বাংলাদেশ এবং এদেশে প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় অংশীদার ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্স ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক্সের সহযোগিতায় নরসিংদীতে স্থাপিত হাই-টেক ফ্যাক্টরিতে দেশীয় বাজারের জন্য স্মার্টফোন সংযোজন করছে।
মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “দেশে সংযোজন হওয়াতে হ্যান্ডসেট কম মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া এ খাতে ১৫ হাজারের বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে, আগামীতে এ সুযোগ আরও বাড়বে। হ্যান্ডসেট তৈরিতে যে দক্ষ শ্রমিক তৈরি হবে এ সুযোগ আগে ছিল না। এ খাতে দক্ষতা অর্জন শুরু হয়েছে এবং আগামীতে এ খাতে হ্যান্ডসেট পুরোপুরি দেশেই তৈরির সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হবে।”
কারখানাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলো প্রথমে পুরোটা সক্ষমতা নিয়ে শুরু করতে পারেনি। সংযোজন কারখানাগুলো এখন শুধু এ কাজ করলেও আগামীতে আরও বড় পরিসরে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।”
চাহিদার ৬০ শতাংশ ফিচার ফোন দেশীয় কারখানাগুলোতেই তৈরি হচ্ছে, এ বছরেই তা শতভাগে উন্নীতের আশা করছে খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিএমপিআইএ’র যুগ্ম সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “কয়েকটি কারখানা ইতোমধ্যে মাদারবোর্ড তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছে, আগামীতে এসব যন্ত্রাংশ তৈরির মাধ্যমে এক সময়ে পুরো হ্যান্ডসেটই দেশে উৎপাদন সম্ভব হবে। এছাড়া দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিতেও বড় ভূমিকা পালন করবে এ খাত।”
ট্রানশান বাংলাদেশের (কার্লকেয়ার টেকনোলজি বিডি লিমিটেড, টেকনো ও আইটেল ব্র্যান্ড) সিইও রেজওয়ানুল হক বলেন, “টেকনো ও আইটেল ব্র্যান্ড নিয়ে বছরে প্রায় ৫৫ লাখ ইউনিট হ্যান্ডসেট তৈরি হচ্ছে কারখানায়। প্রায় দুই বছর ধরে শুরু হওয়া কারখানায় বছরে ১৫ লাখের বেশি স্মার্ট হ্যান্ডসেট তৈরি করা হচ্ছে। চলতি বছরের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদনও বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে।”
২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ হ্যান্ডসেট সংযোজন করে যাচ্ছে।
ওয়ালটনের হেড অব সেলস আসিফুর রহমান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত বছর মহামারীর সময়ে ফিচার ও স্মার্টফোন মিলিয়ে মোট ৪৪ লাখ ইউনিট উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে চার লাখ স্মার্টফোন তৈরি করা হয়েছে। আগামী বছর এ উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল টেলিফোন সেট উৎপাদনের ওপর মূসক অব্যাহতি রয়েছে। এ কারখানাগুলো যাতে টিকে থাকতে পারে সেজন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কম্পিউটারসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস যাতে দেশে সংযোজন ও তৈরি করা যায় সে বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।”