ক্যাটাগরি

‘নেত্রী যেখানে যে কাজ দেবেন, তাই করব’

স্বল্প এই সময়ের মধ্যে প্রবীণ বয়সে দৌড়ঝাঁপ করে
করপোরেশনের কাজে গতি বাড়াতে সুজনের চেষ্টা ছিল দৃশ্যমাণ, প্রশংসাও কুড়িয়েছেন বিভিন্ন
মহল থেকে।

ভোট হয়েছে, নির্বাচিত মেয়র এখন দায়িত্ব নেবেন। সোমবারই
সিটি করপোরেশনে নিজের কাজ গুছিয়ে বিদায় নিয়েছেন সুজন।

এখন কী করবেন- প্রশ্ন করা হলে প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ
নেতা বলেন, “আমি কাজের লোক, রাজনৈতিক কর্মী। রাস্তার লোক, পথেই বেঁধেছি আমার ঘর। মৃত্যুর
আগ পযয়ন্ত কাজ করতে চাই।

“করপোরেশনের সব কাজে অংশ নিয়েছি। ময়লাও টেনেছি। নেত্রী
যেখানে যে কাজ দেবেন, সে কাজ আমি করব।”

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সুজন এই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ
কোনো দায়িত্ব পালন করলেন।

আর তাতে যে তিনি সফল, তা বলেছেন যুদ্ধাপরাধ
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী
নওফেল।

সুজন চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ছিলেন প্রয়াত মেয়র এ বি এম
মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছায়াসঙ্গী। মহিউদ্দিনপুত্র নওফেল মনে করেন, সুজনকে ‘আরও
মূল্যায়ন’ করা প্রয়োজন।

মহিউদ্দিনের ‘ছায়াসঙ্গী’ চট্টগ্রাম সিটির প্রশাসক
 

সুজনের সময় স্বল্প, কিন্তু স্বপ্ন অনেক

সুজনের ‘আরও মূল্যায়ন’ চান নওফেল
 

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সিসিসি নির্বাচন স্থগিত
হলে ৬ অগাস্ট প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন সুজন। ২৭ জানুয়ারি সিটি ভোটে নতুন মেয়র
নির্বাচিত হওয়ার পর সোমবার সিসিসিতে শেষ দিন কাজ করেন তিনি।

মঙ্গলবার ছিলেন বিশ্রামে; এর মধ্যে বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের ছয় মাসের দায়িত্ব পালন নিয়ে কথা বলেন
সুজন।

দায়িত্ব গ্রহণ করেই নগরীর বেহাল সড়কের হাল ফেরানোর
কথা বলেছিলেন সুজন।

প্রশ্ন ছিল সেটা কতটা পেরেছেন? পোর্ট কানেক্টিং (পিসি)
সড়কের সর্বশেষ অবস্থা কী?

জবাবে সুজন বলেন, “এই শহরে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বেহাল
রাস্তা। মানুষের মন খারাপ হত রাস্তায় বের হলেই। চেষ্টা করেছি যেন নগরবাসীর মন
খারাপ না হয়। মাঝখানে দু’মাস বৃষ্টি না হলে আরও আগেই ঠিক করতে পারতাম। পিসি রোড ও
স্ট্র্যান্ড সড়ক বাদে আর শহরের কোনো রাস্তা বাকি নেই। মেরামত শেষ করেছি। ভাঙা
রাস্তা এখন ইতিহাসের বিষয়।

“পিসি রোড এই শহরের লাইফ লাইন। কিন্তু সেটা গর্তে ছিল,
টেনে তুলেছি। ক্ষমাপ্রার্থী, পুরো শেষ করতে পারিনি। অদক্ষ অপেশাদার ঠিকাদার। তাদের
সাথে যুদ্ধ করেও আমি পারিনি। কতবার সেই রাস্তার কাজ দেখতে গিয়েছি আপনারা দেখেছেন। সবশেষ
জাইকার সাথে কথা হয়েছে। সেখানে সময় নিয়েও কাজ না করা দু’জন ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল
করা হয়েছে। আর সদরঘাট স্ট্র্যান্ড রোড দৃশ্যমান করেছি। এখন শেষ পর্যায়ের কাজ
চলছে।”

শহরের সড়কগুলোতে আলো জ্বালাতে চেয়েছিলেন, সেটা কতটা
পূরণ হল- জানতে চাইলে সুজন বলেন, “৭৫ কিলোমিটার সড়ক বাতি লাগিয়েছি। বহদ্দারহাট
থেকে নতুন ব্রিজ পর্যন্ত সড়কে কোনো লাইটের ব্যবস্থাই ছিল না। সড়ক ও জনপথ বলেছে,
তারা লাগাতে পারবে না। স্থানীয় সরকরামন্ত্রীকে অনুরোধ করে অনুমোদন করিয়েছি,
এডিবিরি অর্থায়নে সিসিসি ওই রাস্তায় আলোকায়ন করে দিবে। অন্য সড়কগুলোতে কাজ চলমান, আগামী
দুই মাসের মধ্যে সব সড়ক আলোকিত হয়ে যাবে।”

‘যেখানে সেখানে পড়ে থাকা’ আবর্জনা সরাতে কী কী উদ্যোগ
নিয়েছেন- জানতে চাইলে বিদায়ী প্রশাসক বলেন, “পরিচ্ছন্ন কর্মীরা দিন-রাত কাজ করে।
তাদের পোশাক ছিল না, তাদের পোশাক দিয়েছি। তাদের সাথে থেকে নগরীর পরিচ্ছন্নতার কাজ
করেছি।

“আগের মেয়র সব খোলা ডাস্টবিন ভেঙে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন
ফুটফুটে বাগান হবে। হয়েছিল ফুটফুটে দোকান। পরিচ্ছন্নতা বিভাগে অনেকেই নামে থাকলেও
বাস্তবে কাজ করত না। তাদের কাজে ফিরিয়েছি।”

চেষ্টা করেছি আন্তরিকভাবে: সুজন
 

নিজের নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে চালু
করা স্বাস্থ্যসেবায় প্রাণ ফেরানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন সুজন। তা কতটা করতে পারলেন ছয়
মাসে?

সুজন দাবি করেন, সিসিসি’র চিকিৎসা ব্যবস্থাকে খাদ থেকে
টেনে তুলেছেন তিনি।

“নগরবাসী সহযোগিতা নিয়ে মোস্তফা হাকিম মাতৃসদন
হাসপাতালটি ঠিক করেছি। মেমন হাসপাতাল ঠিক করতে কিছু বেসরকারি হৃদয়বানের সহায়তার
আশ্বাস নিয়েছি। মিডওয়াইফারি জরাজীর্ণ ছিল। গ্যাসের লাইন কাটা ছিল। পরে গ্যাসের
লাইন চালু করেছি।”

ফুটপাত নগরবাসীর চলাচলের উপযুক্ত করা উদ্যোগ নিয়ে কতটা
কার্যকর করতে পেরেছেন?

এই প্রশ্নের উত্তরে সুজন বলেন, “ফুটপাতের হকারদের
উচ্ছেদ করার পক্ষে আমি না। তবে তারা যেন মানুষের পথের কাঁটা না হয়। হকার নেতাদের
একটা পরিকল্পনা জানিয়েছি। বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা তারা বসবেন। কোনো কাঠামো হবে না,
চৌকি হবে না। রাতে সিসিসির লোক পরিষ্কার করবে। পরদিন সকালে যেন পথচারীর চলাচলে
কোনো বাধা না হয়। ৭০-৭৫ ভাগ সফল হয়েছি। একটা অনুরোধ পুলিশ যেন রাস্তায়
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে কাউকে এলাউ না করে।”

সৌন্দর্য বর্ধনের বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম এবং সিসিসি’র
অভ্যন্তরীণ অনিয়ম নিয়ে মেয়াদের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে সরব ছিলেন সুজন।

সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিপ্লব উদ্যানে এত
বড় জমিতে দোকান দিয়ে ভরানো হয়, একশ কোটি টাকার সম্পত্তি এক লাখ টাকা কর ধার্য করে বার্ষিক
বরাদ্দ দেয়া হয়। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করেছি।

“আর্থিক অসঙ্গতি সত্ত্বেও সময়মত বেতন দিয়েছি। ২০১৩থেকে
২০১৮ সালের অর্ধেক পর্যন্ত অবসরে যাওয়াদের আনুতোষিক দিয়েছি। কিছু ঠিকাদারের বিলও
দিয়েছি। একমাসের বেতন আগামী মেয়রের জন্য রেখে এসেছি।”

 

সুজন বলেন, “দুর্নীতি পুরোপুরি নির্মূল করতে পারিনি,
নিয়ন্ত্রণে এনেছি অনেকটা। কর্মকর্তাদের একজনের কাছে অনেক দায়িত্ব ছিল, তা কমিয়েছি।
রাজস্ব সার্কেলগুলোতে অনুসন্ধান করে অনিয়ম পেয়েছি। বদলি ও সাসপেন্ড করেছি।

“তেলের খরচ কমাতে বেসরকারি পাম্প থেকে নিয়ে পরীক্ষা
করি। প্রথম ১৫ দিনে ৩৬ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়। ছয় মাসে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা সাশ্রয়
হয়েছে।”

সিসিসি’র আয় বাড়াতে চেনা পথে না হেঁটে বিভিন্ন সরকারি
সংস্থার আয়ের অংশ বিশেষ দাবি করেন প্রশাসক সুজন। এমনকি এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন
সংস্থায় চিঠিও দেন।

সেই প্রস্তাব কেন এবং তা কতদূর এগিয়েছে- জানতে চাইলে
সুজন বলেন, “শহরের যারা বেনিফিশারি তাদের মধ্যে বন্দর কাস্টমস ইপিজেডসহ বড় বড়
প্রতিষ্ঠান যদি কন্ট্রিবিউট করে তাহলে সিসিসি সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই
উন্নয়ন কাজ ও কাঠামোগত কাজ করতে পারবে।

“অগ্রগতি হয়েছে, বন্দর নীতিগতভাবে মেনেছে। কিছু
রাস্তার দায়িত্ব তারা নেবে। কিন্তু সেটা আমি চাইনি। আমি চেয়েছি এসব সংস্থা নগরবাসীর
মতো হোল্ডিং ট্যাক্স দেবে। পাশাপাশি আয়ের থেকে কিছু শতাংশ হারে সিসিসিকে দেবে।
কাস্টমস বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স আদায় করে। এক শতাংশ দিলে কত হয়? যদি
ইপিজেডডের একটা ফ্যাক্টরি বছরে ১০০-১৫০ ডলারও দেয়। বড় বড ও সিমেন্ট প্রস্তুতকারক
কারখানা থেকে যদি গাড়ির ওভারলোডের জন্য চার্জ আদায় করতে পারি। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী
বলেছেন, এলাকা থেকে যারা আয় করবে তাদের কিছু ব্যয় করা উচিত।”

নগরীর গণপরিবহন ও হাসপাতাল সংকট মেটাতেও উদ্যোগ নেন
সুজন।

সে বিষয়ে বলেন, “যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে
বিআরটিসির ২৬টি বাস পেয়েছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে পতেঙ্গা-হালিশহর
এলাকার জন্য একটি হাসপাতালের অনুমোদন পেয়েছি। চট্টগ্রাম-মিরসরাই প্রতি ঘণ্টায়
কমিউটার ট্রেন, চট্টগ্রাম-দোহাজারি ও চট্টগ্রাম-নাজিরহাট লাইনে দিনে ৮ জোড়া ট্রেন চলাচলের
প্রস্তাব দিয়েছি। চালু হলে নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা পাল্টে যাবে।

শুরুতে প্রতিশ্রুতি না থাকলেও খাল পরিষ্কারে কেন শেষ
সময়ে মাঠে নামলেন?

এই প্রশ্নের উত্তরে সুজন বলেন, “নগরীতে মশার উপদ্রব
বেড়েছে। বিবেচনা করে দেখলাম, বছরের পর বছর খাল নালা পরিষ্কার করা হয়নি। এছাড়া জলাবদ্ধতার
প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন খালে বাঁধ দেয়ায় ময়লা জমেছে। পানির গতি রুদ্ধ। মশার প্রজনন
হচ্ছে। সরকারি বিশেষ বরাদ্দ ছাড়াই বিদ্যমান কাঠামো দিয়েই এটা করেছি। নিজে গিয়ে হাত
লাগিয়েছি। ১৮টা খাল পরিষ্কার করেছি।

“আগে কেন খালগুলো পরিষ্কার হলো না, তারা জানেন। যে কোনো
কাজ নিবেদন নিয়ে করতে হবে। কী সমস্যা, কীভাবে করবেন, কাদের দিয়ে করবেন, তা ভাবতে
হবে।”

নিজেরে কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন নগরবাসীর হাতেই দিয়ে সুজন
বলেন, “কতটুকু সফল তা নগরবাসী মূল্যায়ন করবে। সন্তুষ্ট হলে দোয়া করবেন, অসন্তুষ্ট
হলে যেন ক্ষমা করে দেন। কোনো মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে সেবা দিতে বিলম্ব করিনি। বুকে
হাত দিয়ে বলতে পারব, অনিয়ম-দুর্নীতি করিনি। কোনো অন্যায় করিনি।”

নতুন মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীকে ‘পরিণত রাজনৈতিক
নেতা’ উল্লেখ করে সুজন বলেন, “বিশ্বাস করি তিনি ভালো করবে। করপোরেশনকে যেন দলীয়
কার্যালয় না করেন।”

“বিদ্যমান অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে
হবে। বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে চেষ্টা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনতে হবে। কোথাও
অতিরিক্ত লোক থাকলে কমাতে হবে। অডিট করে অনিয়ম পেলে তা থেকে সিসিসিকে বের করে আনতে
হবে,” দলীয় নেতা রেজাউলের প্রতি সুজনের পরামর্শ।