উইঘুর ক্যাম্পে যা ঘটছে সেই ভয়াবহতা উঠে এসেছে সেখানে একসময়কার বন্দিদের কথায়। তাদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই বিবিসি বুধবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
শিনজিয়াংয়ের বন্দিশিবিরে নয় মাস ছিলেন তুরসুনাই জিয়াউদুন। গতবছর সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শিনজিয়াং ছেড়ে পালান জিয়াউদুন। তিনি প্রথমে কাজাখস্তানে ছিলেন। পরে চলে যান যুক্তরাষ্ট্র। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।
তিনি জানান, বন্দিশিবিরে সে সময় করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব না থাকার পরও সেখানকার পুরুষরা সব সময় মাস্ক পরত, স্যুট পরত, তবে সেই স্যুট ঠিক পুলিশের উর্দির মতো ছিল না।
সেই পুরুষেরা কখনও কখনও মধ্যরাতের পর শিবিরের সেলে এসে নারী বাছাই করে তাদেরকে ‘বিশেষ’ কক্ষে নিয়ে যেত; যে কক্ষে কোনও নজরদারি ক্যামেরা থাকত না।
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় জিয়াউদুন বলেন, তাকেও কয়েক রাতে সেল থেকে বিশেষ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার সঙ্গে শিবিরে যা ঘটেছে, তা ভোলার নয়। এটি সম্ভবত তার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষত, এ ব্যাপারে তিনি আর কিছু বলতেও চান না।
শিনজিয়াংয়ের শিবিরে থাকা বন্দিদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জানতে পারা বিরল ঘটনা। তবে জিয়াউদুনের মতো ওই শিবিরের সাবেক আরও কিছু বন্দী ও রক্ষী তাদের অভিজ্ঞতা বিবিসি-কে জানিয়েছে। তারা সবাই ওই শিবিরগুলোতে গণধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছে।
ভুক্তভোগী জিয়াউদুন বলেন, প্রতি রাতেই শিবিরের সেল থেকে নারীদের নিয়ে গিয়ে এক বা একাধিক মাস্ক পরা চীনা পুরুষ তাদেরকে ধর্ষণ করেন। জিয়াউদুন নিজেও একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং প্রতিবারই দুই বা তিনজন তাকে ধর্ষণ করেছে বলে জানিয়েছেন।
‘সবাইকে (উইঘুর) শেষ করে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য’, বলেন জিয়াউদুন। আগেও জিয়াউদুন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে তা কাজাখস্তান থেকে। সেখানে তিনি চীনে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকিতে ছিলেন।
জিয়াউদুনের ভাষ্য পুরোপুরি যাচাই করা যায়নি। কারণ, চীনে সাংবাদিকদের ওপর কঠোর বিধি জারি আছে। তবে তার বিবরণের সঙ্গে চীনের শিনজিয়াংয়ের বন্দিশিবির নিয়ে বিবিসি’র স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ এবং অন্যান্য সাবেক বন্দিদের ভাষ্যের মিল রয়েছে।
কাজাখ এক নারীরও সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। গুলজিরা নামের এই নারীও শিনজিয়াংয়ের উইঘুর বন্দিশিবিরে আটক ছিলেন ১৮ মাস। তাকে চীনা পুরুষদেরকে নারী ধর্ষণে সহযোগিতা করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
সে অভিজ্ঞতা বর্ণনায় গুলজিরা বলেন,তাকে নারীদেরকে বিশেষ কক্ষে নিয়ে হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিতে হত, যাতে তারা নড়াচড়া করতে না পারে। এভাবেই তাদেরকে পুরুষদের কাছে কক্ষের ভেতরে রেখে চলে যেতে হত এবং পরে এসে কক্ষ পরিষ্কার করতে হত। রক্ষীদেরকে হয় এভাবে সহযোগিতা করা, নয়ত শাস্তি ভোগ করা ছাড়া গুলজিরার আর কোনও পথ ছিল না।

চীন শিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক নিন্দা এবং চাপের মধ্যেও বন্দিশিবিরের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। উইঘুরদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলে চীন দাবি করলেও শিনজিয়াংয়ে বিপুল সংখ্যক নতুন বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়ার কথা গতবছর সেপ্টেম্বরেই নতুন একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা।
‘অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইন্সটিটিউট’ (এএসপিআই) বলছে, শিনজিয়াংয়ে আনুমানিক ৩৮০ টি বন্দিশিবির আছে। যা আগের ধারণার চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। চীন এই বন্দিশিবিরগুলোকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বলে দাবি করে আসলেও যুক্তরাষ্ট্র এই কেন্দ্রগুলোকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গেই তুলনা করেছে।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোও বলছে, অন্তত ১০ লাখ উইঘুর ও অন্যান্য তুর্কিভাষী-মুসলিম অধিবাসীদের এই সমস্ত আটককেন্দ্রে বন্দি করে রাখা হয়েছে। শিবিরগুলোর ব্যবস্থা গোপনীয় হওয়ায় সেখানে কী চলছে তার খবর তেমন বাইরে আসে না।
বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ অনুযায়ী উইঘুরদের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালে উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটি সন্ত্রাসী হামলার পর শিনজিয়াং সফর করেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে ফাঁস হওয়া এক নথি থেকে জানা যায়, এরপরই প্রেসিডেন্ট শি স্থানীয় কর্মকর্তাদেরকে উইঘুরদের ‘কোনওরকম দয়া না দেখানোর’ নির্দেশ দিয়েছিলেন।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকার চীনের উইঘুর নিপীড়নকে ‘গণহত্যার’ তকমা দিয়েছে। তবে চীনের দাবি, উইঘুরদের গণহারে আটক এবং জোর করে উইঘুর নারীদের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করার অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।
নির্যাতনের শিকার জিয়াউদুন বলেন, “তারা (চীন কর্তৃপক্ষ) বলে শিবির থেকে লোকজনকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি বলব, যারাই শিবির থেকে ছাড়া পেয়েছে তারা প্রত্যেকেই শেষ হয়ে গেছে।”
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে জিয়াউদুন বলেন, তার কেবল অস্তিত্বটুকুই আছে। এছাড়া তিনি আসলে ‘মৃত’। ধর্ষণের শিকার হয়ে তিনি পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছেন।