রাজধানীর প্রবেশমুখ গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পানি ছিটানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সেই সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় উপর থেকে পানি ছিটাতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; যাতে রাস্তার পাশের ছোটোখাটো গাছে জমে থাকা ধুলা-ময়লা পরিষ্কার হয়।
আর পানির ঘটাতি তৈরি হলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশকে পানি সরবরাহ করতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
আদেশ পাওয়ার এক মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করে হলফনামা আকারে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাই কোর্ট।
এ বিষয়ে বিচারাধীন একটি রিট মামলায় সম্পূরক আবেদনের শুনানির পর বিচারপতি মো.আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেয়।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আমাতুল করিম।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন সাঈদ আহমেদ রাজা, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তৌফিক এনাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলি এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
মনজিল মোরসেদ পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকা ও আশপাশের এলকার বায়ু দূষণ রোধে গত বছর জানুয়ারিতে হাই কোর্ট ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পরে ফেব্রুয়ারিতে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হলে বায়ু দুষণ কিছুটা কমে আসে।
“শীতকালে বাতাসে ধুলো-বালির পরিমাণ এমনিতেই বেড়ে যায়। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে গত কয়েকমাস বায়ু দূষণ কম ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার হওয়ার সাথে সাথে আবার দূষণ বেড়েছে। সম্প্রতি বায়ু দূষণে ঢাকার অবস্থান বিশ্বে এক নম্বরে উঠে আসে।”
আইনজীবী মনজিল বলেন, ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতার কথা এসেছে। সিটি করপোরেশন বলেছে পানি ছিটানোর গাড়ির সংখ্যা কম থাকায় ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে পানি ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে ঢাকা শহর ও আশেপাশের এলকার বায়ু দূষণ বন্ধে আরও পাঁচ দফা নির্দেশনা চেয়ে বৃহস্পতিবার একটি সম্পূরক আবেদন করে রিটকারী পক্ষ। তার মধ্যে তিনটি বিষয়ে এদিন আদালত নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানান এ আইনজীবী।
বায়ু দূষণ বন্ধে হাই কোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিবাদীদদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিবাদীদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে মন্ত্রীপরিষদ সচিব ও ঢাকার সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরে চাহিদা অনুযায়ী অবিলম্বে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিতে জনপ্রশাসন সচিবের প্রতি নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছিল সম্পূরক আবেদনে।
প্রেক্ষাপট
ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর-প্রতিবেদন যুক্ত করে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) পক্ষে রিট আবেদন করে। ওই আবেদনের শুনানি শেষে আদালত রুলসহ আদেশ দেয়।
আদেশে বলা হয়, ঢাকা শহরে যারা বায়ু দূষণের কারণ সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সপ্তাহে দুই বার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তরকে।
সেদিন আদালত আদেশে বলে দেয়, রাজধানীর যেসব জায়গায় উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ চলছে, সেসব জায়গা ১৫ দিনের মধ্যে এমনভাবে ঘিরে ফেলতে হবে, যাতে শুকনো মৌসুমে ধুলো ছড়িয়ে বায়ু দূষণ বাড়তে না পারে।
পাশাপাশি ‘ধুলোবালি প্রবণ’ এলাকাগুলোতে দিনে দুই বার করে পানি ছিটাতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিতে হবে সিটি করপোরেশনকে।
সেই সঙ্গে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ রোধে প্রশাসনের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে।
বন ও পরিবেশ সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, নির্বাহী কর্মকর্তা, ডিএমপি কমিশনার, রাজউকের চেয়ারম্যানসহ ১১ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
ওই আদেশের পর ২০১৯ সালের নভেম্বরে এইচআরপিবির পক্ষ থেকে সম্পূরক আবেদন করে আবার পাঁচটি নির্দেশনা চাওয়া হয়।
সে আবেদনের শুনানির পর ২৬ নভেম্বর আদালত ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার বায়ু দূষণ কমাতে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের জন্য পরিবেশ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়।
দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিআরটিএ ও ডেসকোর প্রতিনিধিকে কমিটিতে রাখতে বলা হয় এবং এই কমিটিকে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলে আদালত।
এছাড়া প্রয়োজনে অতিরিক্তি লোকবল নিয়োগ করে রাস্তা, ফুটপাথ, ফ্লাইওভার, ওয়াকওভারের যেসব জায়গায় ধুলাবালি, ময়লা বা বর্জ্য-আবর্জনা জমিয়ে রাখা হয় বা জমে থাকে, সেসব ধুলাবালি, ময়লা, বর্জ্য-আবর্জনা সাত দিনের মধ্যে সিটি করপোরেশনকে অপসারণ করতে বলা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে এইচআরপিবির আরেকটি সম্পূরক আবদন করে। সে আবেদনে ১২ নির্দেশনা চাওয়া হলেও হাই কোর্ট গতবছর ১৩ জানুয়ারি নয়টি নির্দেশনা দিয়ে আদেশ দেয়।
হাই কোর্টের ৯ নির্দেশনা
>> ঢাকা শহরে মাটি, বালি, বর্জ্য ও মালামাল ঢেকে পরিবহন করতে হবে।
>> চারপাশ ঘিরে উন্নয়ন বা নির্মাণ কাজ করতে হবে। মাটি, বালি, সিমেন্ট, পাথরসহ নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে।
>> ঢাকার রাস্তায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সকাল-বিকাল পানি ছিটাতে হবে সিটি করপোরেশনকে।
>> রাস্তা, কালভার্ট, কার্পেটিং, খোঁড়াখুড়ির কাজ অইন ও দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী নিশ্চিত করতে হবে।
>> যেসব যানবাহন নির্ধারিত মাত্রার বেশি কালো ধোঁয়া ছড়ায় সেগুলো জব্দ করতে হবে।
>> সড়ক পরিবহন আইনের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক যানবাহনের ‘ইকোনোমিক লাইফ’ নির্ধারণ করতে হবে। যেসব পরিবহনের ‘ইকোনোমিক লাইফ’র মেয়াদ পেরিয়ে গেছে, সেসব যানবাহন নিষিদ্ধ করতে হবে।
>> ঢাকা ও তার আশেপাশের এলকায় অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে হবে।
>> পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া টায়ার পোড়ানো বা ব্যাটারি রিসাইকেলিং বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
>> শপিং মল, বাজার, দোকানের প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগ ভরে নির্ধারিত জায়গায় রাখতে হবে এবং সেগুলো অপসারণে সিটি করপোরেশনকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এছাড়া ঢাকার বায়ুমান উন্নয়নে পরিবেশ অদিদপ্তর কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং অধিদপ্তরে জনবল নিয়োগের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা সেদিন জানতে চায় হাই কোর্ট।
এর মধ্যে করোনাভাইরাসে বায়ু দূষণ মৃত্যু ঝুঁকি বাড়াতে পারে, গণমাধ্যমে এমন প্রতিবেদন দেখে গত বছর ১৫ নভেম্বর এইচআরপিবির পক্ষ থেকে আরেকটি সম্পূরক আবেদন করা হয়েছিল।
সে আবেদনের শুনানির পরই গত ২৪ নভেম্বর আদালত ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ জানতে চায়। ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিয়ে তা জানাতে বলা হয়।
তার ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। সেখানে ফের ৫ দফা নির্দেশনা চেয়ে সম্পূরক আবেদন করে এইচআরপিবি। যার শুনানির পর নতুন করে তিনটি নির্দেশনা দিল আদালত।