তিনি বলেন, “আমি বলব না সে (বার্গম্যান) অসৎ মানুষ ছিল। আসলে অপরিণত, সাংবাদিকতার বিষয়গুলো বোঝার বাকি।”
তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিচারে, বার্গম্যানের কাজে ‘সাংবাদিকতার চেয়ে অ্যাক্টিভিজম’ বেশি গুরুত্ব পায় এবং ‘পক্ষপাতের’ কিছু বিষয়ও সেখানে আছে।
শনিবার রাতে একাত্তর টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠান একাত্তর মঞ্চে কথা বলছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক। তার সঙ্গে সহ আলোচক ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করতে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার চালানোর অভিযোগে ২০১৪ সালে ডেভিড বার্গম্যানকে আদালত অবমাননার দায়ে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।
যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদের মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে একটি ব্লগে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ লেখার কারণে তাকে ওই শাস্তি দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।
কয়েকদিন আগে আল-জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ প্রতিবেদনের সঙ্গে যারা জড়িত, ব্রিটিশ নাগরিক বার্গম্যান তাদের একজন। আর ওই প্রতিবেদনটিই ছিল শনিবার রাতে একাত্তর টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু।
সঞ্চালক নুর সাফা জুলহাজের প্রশ্নে ওই প্রতিবেদন নিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী যখন নিজের মতামত জানাচ্ছিলেন, তখন বার্গম্যানের প্রসঙ্গও আসে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, আল-জাজিরার ওই প্রতিবেদনের কাজে যারা জড়িত, তাদের একজনকে তিনি চেহারা ও নামে চেনেন। আরেকজনের নাম শুনেছিলেন, চেহারা ওই প্রতিবেদনেই প্রথম দেখেছেন।
“আরেকজন হচ্ছেন, তিনি কিছুদিন আমাদের জন্যও কাজ করেছেন, ডেভিড বার্গম্যান। ডেভিডের এক ধরনের এজেন্ডা আছে, সেটা বোঝা যায় তার সাথে কাজ করলে।”
তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিচারে, সাংবাদিকতা আর ‘অ্যাক্টিভিজমের’ পার্থক্যটা ডেভিড বার্গম্যান বোঝেন না
তৌফিক খালিদী বলেন, ২০১০ সালে মাস ছয়েকের কম সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে কাজ করেছিলেন বার্গম্যান। তার আগে ছিলেন ডেইলি স্টারে।
“তার পারিবারিক এক বন্ধু আমার কাছে নিয়ে এসেছিল, ’একজন আছে কাজ করতে চায়’। কে? ‘ডেভিড বার্গম্যান। ‘হু ইজ ডেভিড বার্গম্যান? ‘উনি ওয়ার ক্রাইমস ফাইল বানিয়েছিল চ্যানেল ফোরের জন্য।’ ও আচ্ছা আচ্ছা। গুড ব্যাকগ্রাউন্ড। তাহলে তো আমার আর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে হবে না। আসুক।”
বার্গম্যান সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যোগ দেওয়ার জন্য কথা বলে গেলেও যোগ দেন ডেইলি স্টারে। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর আবার এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যোগ দেওয়ার আগ্রহ দেখান।
সেই সময়ের কথা স্মরণ করে প্রধান সম্পাদক বলেন, “আমরা তখন ডেসপারেটলি খুঁজছি, ইংরেজি কপি রাইটার। আমার সাংবাদিক দরকার নাই, আমার রিপোর্টার দরকার নাই, আমার এডিটরিয়াল লিডার দরকার নাই; আমার এডিটরিয়াল ডিসিশন মেকিংয়ের দরকার নাই, গেইট কিপিংয়ের লোক দরকার নাই, আমার দরকার হচ্ছে ইংরেজি শুদ্ধ করে দেবে এই রকম নেইটিভ স্পিকার… আমি খুশি হয়ে গেলাম। ঠিক আছে, ওকে নিলাম।”
কিন্তু কাজ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে বার্গম্যানের বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তাকে চেনার বিষয়টিও আলোচনায় তুলে ধরেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
“কিছু কিছু হেডলাইনে তার সন্দেহ হয়, ‘এগুলো বোধহয় ঠিক না’। আমি বলি, দেয়ার ইজ আ ডিফ্রেন্স বিটুইন অ্যাক্টিভিজম অ্যান্ড জার্নালিজম। ইউ আর বিহেভিং মোর লাইক অ্যান অ্যাক্টিভিস্ট। ইউ আর বিহেভিং মোর লাইক আ ব্লগার। ইউ আর নট বিহেভিং অর থিংকিং লাইক আ জার্নালিস্ট।
“যেমন ধরুন, একটি বিশেষ কোম্পানি বড় বড় কিছু অ্যাকুইজেশন করল… যেগুলো বড় খবর। কিন্তু তার মাথায় ঢুকছে না যে, এগুলো হেডলাইন হয়েছে খবরের মেরিটের ভিত্তিতে। খবরটা অনেক বড় খবর, সেজন্য বড় হেডলাইন করেছি, এজন্য না যে ওই কোম্পানিটা বসুন্ধরা কিংবা বেক্সিমকো। এটা তার মাথায় ঢুকত না। কারণ তার মাথায় ঢুকে আছে অন্য জিনিস।”
বার্গম্যানের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা তুলে ধরে তৌফিক খালিদী বলেন, “সেদিন আমি আইন নিয়ে কথা বলছিলাম… তার একটি ডিগ্রি আছে, এলএসইতে (লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স) মাস্টার্স করেছেন আইন নিয়ে। আমাদের যে লাইবেল লজ, ডিফেমেশন লজ আছে, তা ইংল্যান্ডের মতই…। আইনের সাবেক ছাত্রকে কিছুটা হলেও ডিফেমেশন ল বলতে হয়েছিল।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, ২০০৯ সালে বার্গম্যান প্রথম সাক্ষাৎকার দিতে এসেছিলেন। তারপর ২০১০ সালের মার্চে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যোগ দেন। ওই বছরের অগাস্টে চলে যান। ছয় মাসের কিছু কম সময় তিনি কাজ করেন।
“তার সাথে বিদায়ের বিষয়টি ছিল, এ রকম একটা স্টোরি নিয়ে কথা বলতে এসেছে। তার সন্দেহ হচ্ছিল, যে আমরা অতিরিক্ত সরকার-ঘেঁষা এবং আমরা এই কাজগুলো করছি কোনো একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে।
“আমি তাকে যা বলেছিলাম তার সারমর্মটা বলি- আমার আসলে কাউকে জমা-খরচ দিয়ে চলতে হয় না। কারও ধামাধরা হয়ে চলতে হয় না। আমাকেও কখনও করতে হয়নি, এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বিভিন্ন রকম বিপদের মধ্য দিয়ে গেছে, কখনো করেনি, এখনও করছে না, করবে না।”
ততদিনে বার্গম্যানের ওপর ‘বিরক্ত’ হয়ে গেছেন জানিয়ে তৌফিক খালিদী বলেন, “সে বিভিন্ন সময়ে এসে বলেছে, আমি এই অফিস নিয়ে একটু তদন্ত করতে চাই, সেই অফিস নিয়ে তদন্ত করতে চাই।
“এরই মধ্যে বিভিন্ন জন আমাকে বলা শুরু করেছে যে, ‘এই নামে কেউ কাজ করে তোমার ওখানে? সে তো তিনমাস আগে আমাকে দুই ঘণ্টা ইন্টারভিউ করে গেল, এখনও তো আমি নিউজের কিছু দেখলাম না।’ আমাদের নাম ব্যবহার করে সে কয়েকটি ইন্টারভিউও করেছে।”
খালিদী বলেন, “সেদিন আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম ডেভিড, তোমার যদি ভালো না লাগে এখানে কাজ করতে, তুমি চলে যাও। অ্যান্ড দ্যাট ওয়াজ দ্য লাস্ট মিটিং উই হ্যাড উইথ ডেভিড বার্গম্যান।”
ব্যক্তিগতভাবে বার্গম্যানের প্রতি কোনো আক্রোশ বা অন্য কিছু নেই মন্তব্য করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, “চলে যাওয়ার পরে সে দীর্ঘদিন ধরে আমার সহকর্মীদের কাছে আমাদের কোম্পানির বিরুদ্ধে, আমার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছে। যার সারমর্ম হচ্ছে- আমরা আসলে সরকারের হয়ে এটা-ওটা করার চেষ্টা করি।”
বার্গম্যানের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রতিবেদন হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “এর মধ্যে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছিল, সেই বিচার নিয়ে তার অসম্ভব উৎসাহ ছিল। উৎসাহটা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।
“আমার সহকর্মীরা যারা সেই ট্রায়াল প্রসিডিংসগুলো কাভার করতেন, তারা অনেকে মিলেই কাভার করতেন। তারা সেখানে তার আচার-আচরণগুলো দেখতেন, যে কার সাথে কথা বলছে, কী করছে। এ নিয়ে আমার সহকর্মীরা দুয়েকটি স্টোরি করেছে, যেগুলো তাকে খুব ভালোভাবে উপস্থাপন করেনি।”
‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে তৌফিক খালিদী বলেন, “আমি যখন দেখলাম সে কথা বলছে, ওই যে বললাম না সন্দেহের ব্যাপারটা চলে এসেছে, ওর একটু বায়াস আছে, একটা দিকে, সেটা হলো একটা বিষয়।”
বার্গম্যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে চলে যাওয়ার কিছুদিন পরে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দুজন তরুণ কর্মকর্তা এক সাক্ষাতে তার বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তৌফিক ইমরোজ খালিদীকে, সে কথাও তিনি অনুষ্ঠানে বলেন।
“তারা অনেক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বললেন। তাদের শেষ প্রশ্ন- হোয়াট ডু ইউ থিংক অব ডেভিড বার্গম্যান।… আমি বলেছিলাম তাদেরকে – ওর একটাই সমস্যা আছে, ও তো ভালো মানুষ। সমস্যাটা হল সাংবাদিকতা এবং অ্যাকটিভিজমের মধ্যে পার্থক্যটা বোঝে না। ও কি, মোর অফ আ ব্লগার দ্যান আ জার্নালিস্ট।”
তৌফিক ইমরোজ খালিদীর একটি বক্তব্যের সূত্র ধরে অনুষ্ঠানের অপর আলোচক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, “একটু দুঃখ রইল, ইংরেজি আমরা বলতে পারি না দেখে সাদা মানুষকে ইংরেজির জন্য আনতে হয়েছিল। এটা দুঃখের ব্যাপার যে, তখন ছিল না আমাদের মধ্যে কেউ।”
তখন তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “এটা বলতে পারার বিষয় না, ইংরেজির কপি এডিট করার মত লোক থাকা… এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষককে আপনি এখানে বসিয়ে দেন, নিউজ কপি এডিট করতে পারবে না। ইটস আ ডিফ্রেন্ট স্কিল। এটা ছিল মূল বিষয়।
“ইংরেজি বলতে পারার বিষয় না, অন্য একজনকে আনলে আমার (ওয়ার্ক পারমিট লাগত), তার জন্য আমার ওয়ার্ক পারমিট লাগবে না, কারণ সে অলরেডি অন্য জায়গায় কাজ করেছে। তার কাজ করার পারমিশন বোধহয় ছিল। অন্যদেরতো আমি আনতেও পারতাম না।”