ক্যাটাগরি

মেয়ার্সের ইতিহাস গড়া ইনিংসে উইন্ডিজের রূপকথার জয়

ক্রিকেট তার যাবতীয় অনিশ্চয়তা, রোমাঞ্চ আর রঙ মেলে ধরল চট্টগ্রাম টেস্টের শেষ দিনে। প্রথম চার দিন ম্যাচ নিয়ন্ত্রণে রেখেও শেষ দিনে পাত্তা পেল না বাংলাদেশ। ৩ উইকেটের জয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এগিয়ে গেল সিরিজে।

সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ একগাদা শীর্ষ ক্রিকেটার না থাকায় যারা খর্বশক্তির দল। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ, টেস্টের আগে ওয়ানডে সিরিজে যারা হয়েছে হোয়াইটওয়াশড।

মূল ক্রিকেটাররা থাকলে যার হয়তো দলে থাকাই হতো না, সেই মেয়ার্স ২১০ রানের অপরাজিত ইনিংসে ক্যারিবিয়ানদের রূপকথাময় জয়ের নায়ক। কদিন আগেও যাকে খুব একটা চিনত না ক্রিকেট বিশ্ব। টেস্ট অভিষিকেই তিনি নিশ্চিত করে দিলেন, তাকে মনে রাখবে ক্রিকেট ইতিহাস!

চতুর্থ ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের লক্ষ্য ছিল ৩৯৫। প্রথম ৩ ব্যাটসম্যানকে হারিয়েছিল তারা ৫৯ রানে। স্পিন সহায়ক মন্থর উইকেটে শেষ দিনে প্রয়োজন ছিল ২৮৫ রান। সবকিছুতেই ছিল বাংলাদেশের জয়ের বার্তা। মেয়ার্স ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সব সমীকরণ বদলে দিল দারুণ এক জয়ের রঙে।

নায়ক মেয়ার্সের সঙ্গে তীব্র আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল পার্শ্বনায়ক দুজনের ছবিও। একজন তার মতোই অভিষিক্ত, এনক্রুমা বনার। শেষ দিন প্রথম দুই সেশনই বাংলাদেশকে উইকেটবিহীন রেখে জয়ের ভিত গড়ে দেয় মেয়ার্স ও বনারের জুটি। উইকেটে দুজনের একসঙ্গে বিচরণ ছিল ৭৩ ওভারের বেশি। ২১৬ রানের সেই জুটিই ক্যারিবিয়ান দুঃসাহসিক জয়ের শিরদাঁড়া।

আরেকজন জশুয়া দা সিলভা। স্কোরকার্ডে যার নামে পাশে রান কেবল ২০। তবে তার অবদানের বিশালত্ব ফুটে উঠবে জুটিতে। শেষ সেশনে যখন দোলাচলে ম্যাচের ভাগ্য, প্রচণ্ড চাপের মধ্যে মেয়ার্সের সঙ্গে জশুয়ার ১০০ রানের জুটিতেই হয়ে যায় ফয়সালা।

মেয়ার্সের ইনিংস ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ে কত রেকর্ড গড়া হলো, সেসবের হিসেব করাও দায়। বাংলাদেশে তো বটেই, এশিয়ায় এত বেশি রান তাড়া করে জয়ের কীর্তি আর নেই। সব মিলিয়ে টেস্ট ইতিহাসে এর চেয়ে বেশি রান তাড়ার ঘটনা আছে মোটে চারটি।

চতুর্থ ইনিংসে দলের জয়ে মেয়ার্সের ২১০ রানের চেয়ে বড় ইনিংস আছে টেস্ট ইতিহাসেই কেবল একটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই কিংবদন্তি গর্ডন গ্রিনিজের অপরাজিত ২১৪। আর অভিষেকে চতুর্থ ইনিংসে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি টেস্ট ক্রিকেট দেখল মেয়ার্সের সৌজন্যেই। আগের সর্বোচ্চ ১৯৫৯ সালে ভারতের আব্বাস আলি বেগের ১১২ পেছনে পড়ে গেল অনেকটাই।

ক্যারিবিয়ানদের কীর্তিময় দিনে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে কেবল হতাশারই আঁকিবুকি। বোলিং দিনজুড়েই ছিল অধারাবাহিক। উইকেট খুব ভয়ঙ্কর টার্নিং না হলেও অনেক বলেই টার্ন মিলেছে বেশ, বাউন্স ছিল অসমান। কিন্তু ক্যারিবিয়ানদের চাপে ফেলার মতো বা পরীক্ষা নেওয়ার মতো টানা ভালো জায়গায় বোলিং করে যেতে পারেননি কেউ। বিশেষ করে অফ স্পিনার নাঈম হাসান প্রায় প্রতি ওভারেই করেছেন আলগা বোলিং।

উরুর চোটের কারণে মাঠে নামতে না পারা সাকিব আল হাসানের অভাব ফুটে উঠেছে প্রকটভাবে। তবে প্রতিপক্ষ আর ম্যাচের পারিপার্শ্বিকতায় এটিকে অজুহাত দাঁড় করানোর উপায় খুব একটা নেই।

অধিনায়ক মুমিনুল হকের নেতৃত্বকেও তোলা যায় কাঠগড়ায়। মাঠ সাজানো, চাপ ধরে রাখতে না পারা, দলের ম্রিয়মান শরীরী ভাষা এসব তো আছেই। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে, নেতৃত্বে সৃষ্টিশীলতার অভাব ও ভিন্ন কিছু না করা। ৪ জন বোলারই বল করে গেছেন দিনজুড়ে। তিনি নিজে আসেনি বা নাজমুল হোসেন শান্তকে ব্যবহার করেননি।

সাকিব ছিলেন না মাঠে, আঙুলের চোটে প্রথম দুই সেশন মাঠে নামেননি তামিম ইকবালও। মাঠে কতৃত্বের অভাবও চোখে পড়েছে। সাকিব অবশ্য মাঠের বাইরে থেকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন যথেষ্ট। চা বিরতির পর তামিম মাঠে নামলেও আবার বাইরে চলে যান ফিল্ডিংয়ের সময় আঙুলে আবার চোট পেয়ে।

বড় তিনটি সুযোগ বাংলাদেশ হাতছাড়া করেছে প্রথম সেশনেই, দুটি রিভিউ না নিয়ে ও একটি ক্যাচ হাতছাড়া করে। মেয়ার্সকে ফেরানো যেত ৪৭ রানেই। তাইজুল ইসলামের বলে জোরালো আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার। বাংলাদেশ নেয়নি রিভিউ। টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, বল লাগছিল স্টাম্পে।

মেয়ার্স একটু পর জীবন পান ৪৯ রানে। মেহেদি হাসান মিরাজের বলে স্লিপে ক্যাচ নিতে পারেননি নাজমুল হোসেন শান্ত। যদিও সুযোগটি ছিল কঠিন।

আউট হতে পারতেন বনারও। নাঈম হাসানের একটি তীক্ষ্ণ টার্ন করা বলা লাগে বনারের প্যাডে। এবারও রিভিউ নেয়নি বাংলাদেশ। বনার বেঁচে যান ২৫ রানে।

৩ উইকেটে ১১০ রান নিয়ে শেষ দিন শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দিনের প্রথম ঘণ্টায় ১৮ ওভারে মেয়ার্স ও বনার যোগ করেন কেবল ৩৯ রান। পরের ঘণ্টায় আলগা বোলিং কাজে লাগিয়ে দুই ব্যাটসম্যান আদায় করে নেন কিছু বাউন্ডারি। এই সময়ে ১৩ ওভারে আসে ৪৮ রান।

সময়ের সঙ্গে বাড়ে দুজনের আত্মবিশ্বাস। বাড়ে রানের গতি। লাঞ্চের পর সেভাবে কোনো সুযোগই দেননি দুজন। দ্বিতীয় নতুন বলেও বাংলাদেশ পায়নি সাফল্য। যথারীতি স্পিনারদের বোলিং ধারহীন, একমাত্র পেসার মুস্তাফিজ অগোছালো।

ধৈর্য্যের পরীক্ষায় উতরে বনার ফিফটি স্পর্শ করেন ১৬৪ বলে। মেয়ার্স প্রথম ফিফটি করেন ৮৯ বলে, পরের ফিফটিও ঠিক ৮৯ বলেই। মুস্তাফিজের বলে বাউন্ডারিতে পূর্ণ হয় তার সেঞ্চুরি।

সেঞ্চুরির পর মেয়ার্স এলোমেলো শট খেলেন কয়েকটি। তবে দ্রুতই সামলে নেন।

অভিষিক্ত দুই ক্রিকেটারের ডাবল সেঞ্চুরি জুটি টেস্ট ইতিহাসে ছিল আগে আর একটিই। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের খালিদ ইবাদুল্লাহ ও আব্দুল কাদিরের ২৪৯। মেয়ার্স-বনার জুটি ছুটতে থাকে সেদিকে। শেষ পর্যন্ত বনারকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের আশাও কিছুটা ফেরান তাইজুল। ২৪৫ বলে ৮৬ করে এলবিডব্লিউ হন বনার।

এরপর জার্মেইন ব্ল্যাকউডের আত্মহত্যায় ম্যাচে ফেরে নতুন উত্তেজনা। নাঈমকে বেরিয়ে এসে খেলতে বাজে শটে বোল্ড হন ব্ল্যাকউড।

বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারেনি সেই জোড়া ধাক্কার সাফল্য। মেয়ার্স ও জশুয়া পথ হারাতে দেননি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।

সময়ের সঙ্গে নিজের শটের পরিধি আর পেশিশক্তির প্রদর্শনীও মেলে ধরতে থাকেন মেয়ার্স। তার সেঞ্চুরিতে ছিল ১২ চার ১ ছয়, ডাবল সেঞ্চুরিতে যেতে চার আসে আর ৮টি, ছক্কা আরও ৫টি!

ডাবল সেঞ্চুরির পরও ছক্কা মারেন আরেকটি। সব মিলিয়ে ৬ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটে ৪১৫ বল খেলে ২১০ রানের মহাকাব্য। এমন কিছু টেস্ট ইতিহাস দেখেছে সামান্যই।

শেষ দিকে জশুয়া ও কেমার রোচ  বিদায় নেন অল্প সময়ের মধ্যে। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় তাতে ম্লান হয়নি একটুও। জয় এনে দেওয়া শটও মেয়ার্সের ব্যাটেই।

আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে আগের ৭ ম্যাচ মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছিল ৪০ পয়েন্ট। এই ম্যাচ জিতে তাদের প্রাপ্তি ৬০ পয়েন্ট। প্রথম পয়েন্টের আশায় থাকা বাংলাদেশ পড়ে রইল শূন্যতেই।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৪৩০

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ম ইনিংস: ২৫৯

বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: ২২৩/৮ (ডি.)

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ৩৯৫, আগের দিন ১১০/৩) ১২৭.৩ ওভারে ৩৯৫/৭ (বনার ৮৬, মেয়ার্স ২১০*, ব্ল্যাকউড ৯, জশুয়া ২০, রোচ ০, কর্নওয়াল ০*; মুস্তাফিজ ১৩-১-৭১-০, তাইজুল ৪৫-১৮-৯১-২, মিরাজ ৩৫-৩-১১৩-৪, নাঈম ৩৪.৩-৪-১০৫-১)

ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩ উইকেটে জয়ী

সিরিজ: ২ ম্যাচ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১-০তে এগিয়ে

ম্যান অব দা ম্যাচ: কাইল মেয়ার্স।