ক্যাটাগরি

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিলেন প্রতিমন্ত্রী খালিদ বাবু

সাক্ষী
খালিদ ময়মনসিংহ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। আসামি হান্নান ছিলেন ময়মনসিংহ-৭ আসনের
সংসদ সদস্য।

বিচারপতি
মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারকের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ
মঙ্গলবার ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষ্য দেন প্রতিমন্ত্রী।

সাক্ষ্যে
মুক্তিযুদ্ধের সময় এম এ হান্নানের ভূমিকা ও অপরাধের বর্ণনা দেন কে এম খালিদ। তখন
তিনি ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়তেন।

তিনি
বলেন, “৭ আগস্ট (১৯৭১)
জোহরের নামাজের পর বাড়ি থেকে সাইকেল যোগে স্বদেশি বাজারের উদ্দেশে রওনা করি। আমি
শহরের নতুন বাজার অতিক্রম করে এম এ হান্নানের (এই মামলার আসামি) বাড়ির সামনে
পৌঁছালে ওই বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়ানো পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর কয়েকজন
আলবদর-রাজাকার আমাকে আটক করে এবং পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে মারতে মারতে এম এ হান্নানের
বাড়ির দোতলায় নিয়ে যায়।

“সেখানে এম এ হান্নান আমাকে
দেখে ও আমার পরিচয় জেনে বলে, ‘তোমার ভাইয়েরা মুক্তিবাহিনীতে গিয়েছে, তোমার বাবাকে
ডেকে এনে অনেকবার সাবধান করার পরও সে কথা শোনেনি’।”

তিনি
বলেন, একথা বলার পর তাকে নিয়ে যেতে রাজাকারদের নির্দেশ দেন হান্নান। এরপর তাকে ময়মনসিংহের
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তান আর্মির নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া
হয়।

“সেখানে আমাকে ওই হলের
দোতলার ২১০ নম্বর রুমে আটক রাখে। আমি ওই রুমে ঢুকে আরও ৪-৫ জন যুবককে সেখানে দেখি।
তারা সকলেই আহত অবস্থায় ছিল। ওই দিন সন্ধ্যার দিকে ময়মনসিংহ জেলা পিস কমিটির সভাপতি
মওলানা ফয়জুর রহমার রহমান (বর্তমানে মৃত) এর ছেলে তৈয়ব (বর্তমানে মৃত) ও তার কয়েকজন
সঙ্গী দুজন লোককে আটক করে নিয়ে এসে আমার কক্ষে নিয়ে আসে। তাদেরকে নির্যাতিত অবস্থায়
দেখি। পরে তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারি, তাদের একজনের মধ্যে নাম উমেদ আলী মাস্টার,
আরেক জনের নাম আব্দুর রহমান। আব্দুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।”

সাক্ষী
খালিদ বাবু বলেন, “ওই রাতে আমাকে ওই রুম থেকে বের করে রাজাকার আলবদররা আমাকে
অনেক নির্যাতন করে। নির্যাতনের অনেক চিহ্ন এখনো আমার শরীরে রয়েছে। একইভাবে ওই কক্ষে
আটককৃত অন্যদেরকেও পর্যায়ক্রমে বের করে নির্যাতন করা হয়।”

১৯৭১ সালের
৯ অগাস্টের ঘটনার বর্ণনায় প্রতিমন্ত্রী বলেন,“সন্ধ্যার দিকে ময়মনসিংহ জেলার শান্তি কমিটির চেয়াম্যান
মওলানা ফয়জুর রহমান (বর্তমানে মৃত) এবং সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান কয়েকজন সহযোগী
নিয়ে আমাদের কক্ষে আসে।

“ওই রুমে তখন আমরা ৮ থেকে
১০ জন আটক ছিলাম। ‍রুমে ঢুকেই তারা বলে ‘এরা এখনো এখানে!’। এ কথা শুনে আমি মাওলানা ফয়জুর রহমানকে সালাম দেই।
তিনি আমাকে দেখে ‘তুমি এখানে?’ বলে রুমে থেকে বেড়িয়ে
যায়।

“পরের দিন সকালে মওলানা
ফয়জুর রহমানের ছেলে তৈয়ব ও তার কয়েকজন সহযোগী আমাদের রুমে যেয়ে আমাকে বের করে নিয়ে
আসে এবং পরে আমাকে ছেড়ে দিলে আমি বাড়ি ফিরে যাই।”

সাক্ষ্য
গ্রহণে ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন। তার সঙ্গে ছিলেন
প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল ও রেজিয়া সুলতানা চমন।

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। ফাইল ছবি

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। ফাইল ছবি

এরপর সাক্ষী
খালিদ বাবুকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার।

জেরার জবাবে
কে এম খালিদ বাবু বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমানের বাড়ি ত্রিশালে। কিন্তু ১৯৭১
সালে তার পরিবারের কাউকে তিনি চিনতেন না। আব্দুর রহমানের স্ত্রী রহিমা খাতুন ১৯৭২ সালে
তার স্বামী হত্যার বিষয়ে কোনো মামলা করেছিল কি না, তাও তিনি জানেন না।

আরেক প্রশ্নের
জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ত্রিশাল নির্বাচনী এলাকায়
জাতীয় পার্টির প্রার্থী হান্নানের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন
না। সেই নির্বাচনে হান্নান মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন।

হান্নান
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে জেরায় আসামির
আইনজীবী দাবি করলে তা প্রত্যাখ্যান করেন খালিদ।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জাপা এমপি হান্নান গ্রেপ্তার
 

ময়মনসিংহের
ত্রিশালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমানের স্ত্রী রহিমা খাতুন ২০১৫ সালের ১৯ মে মানবতাবিরোধী
অপরাধের অভিযোগে মামলা করেন।

এ মামলায়
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হান্নান ও তার ছেলেসহ মোট ৮ আসামির বিরুদ্ধে পরোয়ানা
জারি করলে হান্নান ও তার ছেলে রফিক সাজ্জাদকে ঢাকার গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করে।

ওই দিন
ময়মনসিংহ সদর ও ত্রিশাল থেকে আরও তিন আসামি খন্দকার গোলাম সাব্বির, মিজানুর রহমান মিন্টু
ও হরমুজ আলীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।পরে আরেক আসামি আবদুস সাত্তার ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ
করেন।

ফলে এখন
অবধি এ মামলায় ছয় আসামি কারাগারে আছেন। জামায়াত নেতা ফখরুজ্জামান ও গোলাম রব্বানী নামের
দুই আসামি পলাতক।

আসামিদের
বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, আটক, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, অপহরণ
ও লাশ গুমের ছয় ধরনের অভিযোগ এনে ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। সে অভিযোগ ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে
নেয় ট্রাইব্যুনাল।

পরে ২০১৯
সালের ২৭ মে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।

আসামিদের
বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় আসামিরা ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের ডাক বাংলো,
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল, অভিযুক্ত এম এ হান্নানের বাড়িকে ‘টর্চারসেল’ হিসেবে ব্যবহার করতেন।
সেখানে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে মরদেহ ব্রহ্মপুত্রে ফেলা হত।

অভিযোগ-১:
ময়মনসিংহের গোলকীবাড়ী বাইলেনের প্রখ্যাত ভাস্কর আব্দুর রশিদকে অপহরণের পর জিপ গাড়ির
পেছনে রশি দিয়ে বেঁধে টেনেহিঁছড়ে নির্মমভাবে হত্যা ও লাশ গুম।

অভিযোগ-২:
 ত্রিশাল থানার বৈলর হিন্দুপল্লী ও মুন্সিপাড়ায়
অগ্নিসংযোগ, সেন্টুকে গুলি করে হত্যা ও দুইজন হিন্দুকে গুলি করে আহত করা।

অভিযোগ-৩:
বৈলরের আ. রহমান মেম্বারকে অপহরণের পর হত্যা ও লাশ গুম।

অভিযোগ-৪:
খন্দকার আব্দুল আলী রতনকে অপহরণের পর হত্যা ও লাশ গুম।

অভিযোগ-৫:
মো. আবেদ হোসেন খানকে আটক, নির্যাতন ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর।

অভিযোগ-৬:
কে এম খালিদ বাবুকে (বর্তমান সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী) অপহরণ, আটক ও নির্যাতন।