অন্যের জমি চাষ করে ভাগের ফসলে কোনো রকমে খেয়ে-পরে বেঁচেছিল যে সাঁওতাল পরিবার, তারা এখন পল্লীর স্বচ্ছল পরিবারের মতো পাকা মেঝের ঘরে মাথা রাখছেন। আবার বাঁশ-বেত কেটে কুলা-ডালা বানিয়ে যারা জীবন চালাচ্ছিলেন সেই পাটনিদের ভিটায়ও উঠেছে মজবুত ঘর।
অনেকের কাছেই ‘ছোট্ট’ এই উপহার এসব মানুষের কাছে এসেছে জীবন বদলের উপকরণ হিসেবে।
এতদিনের মাটির ঘরের বসত থেকে নতুন ঘরে উঠে উচ্ছ্বসিত গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামদিয়া ইউনিয়নের চাঙ্গরা গ্রামের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের এলিজাবেথ মুরমু (৩৮)।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্যের জমিতে কাজ করে আগে কোনো রকমভাবে জীবন কাটাতাম, থাকতাম মাটির ঘরে। শীত, রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে ছিলাম বড়ই অসহায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের এখন ঘর করে দিয়েছেন। পেয়েছি নিজের ঠিকানা, সম্মান। এজন্য তার প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ও দোয়া।”
এলিজাবেথের মতো তার গ্রামের ৫০টি সাঁওতাল পরিবার প্রধানমন্ত্রীর এই উপহার পেয়েছেন। গাইবান্ধা ও রংপুর জেলা ঘুরে এ রকম ঘর পাওয়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তাদের ভাষ্য মতে, এই ঘর কেবল তাদের আশ্রয়ই দেয়নি, দিয়েছে সম্মানও।
এলিজাবেথের স্বামী বার্নার্ড বাথুরাম হাজদার বাড়ি দিনাজপুরের বিরামপুর। তিনি কৃষিকাজ করে সংসার চালান। ছেলে সপ্তাপ্ত (১৫) ও মেয়ে শতাব্দীকে (২০) নিয়ে এলিজাবেথ থাকেন তার বাবার বাড়ি চাঙ্গরাতেই।
এ বছর দিনাজপুরের সেন্ট ফিলিপস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা শতাব্দী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ঘর পাওয়ার আগে কোনো দিন বন্ধুদের বলতে পারি নাই, আমরা মাটির ঘরে এত কষ্ট করে বসবাস করি। সব সময় নিজেদের ছোট মনে হত। কিন্তু এবার সবাইকে বলতে পারব, আমাদেরও ঘর আছে। তোমরা চাইলে আমার ঘরে নিমন্ত্রণ নিতে পার।”
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় বসবাসকারী পাটনি সম্প্রদায়ের সদস্যরা বাঁশ দিয়ে ডালা, কুলাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করে সেগুলো বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিদিনের আয় দিয়ে জীবন চালানো মানুষগুলো থাকতেন জীর্ণ ঘরে। নতুন ঘর পেয়ে তাদের জীবনেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া।
পাটনি সম্প্রদায়ের সদস্য ষাটোর্ধ্ব বিনোদ বিহারী দাস বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন ঘর দিয়ে যা উপকার করলেন তা ভোলার নয়। আমরা তার জন্য প্রার্থনা করি। দেশে তার সরকার থাকুক এইটা চাই।”
এই গ্রামের আরেক বাসিন্দা সাবিত্রী রানী দাস। প্রায় চার দশক আগে স্বামী বিনু রাম দাস মারা গেলে বাঁশের সরঞ্জাম বিক্রির আয় দিয়ে তিনি দুই ছেলেকে বড় করেছেন।
সংগ্রামী এই নারী বলেন, “আমরা ঘর পেয়ে যে কত খুশি তা মুখে বলে বোঝানো যাবে না। এখন এই ঘরে বসেই আমরা প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও নিজেদের কাজগুলো চালিয়ে যেতে পারছি। হাতে যা তৈরি করছি সেগুলো বিক্রির আগে নিজেদের ঘরে নিরাপদে রেখে সংরক্ষণও করতে পারছি সহজেই।”
মুজিববর্ষে সমতলে বসবাস করা ৬১ জেলার ৩ হাজার ৫০০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিবারকে ঘর করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই অংশ হিসেবে সাড়ে তিন হাজার নতুন ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এরইমধ্যে অনেকেই নতুন ঘরে উঠেছেন। এ বছরই বাকিরাও উঠবেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্বাহী সেলের মহাপরিচালক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব (পিএমও) তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোকে সাড়ে ৩ হাজার ঘর উপহার দেওয়ার পাশাপাশি এসব পরিবারের স্কুলগামী শিশুদের বাইসাইকেল ও বৃত্তি দিয়েছেন, যাতে তারা সহজে শিক্ষা পেতে পারে।
এদের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যেও ইতোমধ্যে সাড়ে চার হাজার ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মুজিববর্ষে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার’ হিসেবে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় এরইমধ্যে জমির সঙ্গে ঘর পেয়েছে সারা দেশের ভূমিহীন-গৃহহীন অর্ধ লাখের বেশি পরিবার।
এই প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী সরকারের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে। এসব পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমির মালিকানা দিয়ে সেখানে আধা পাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি ২১টি জেলার ৩৬টি উপজেলায় ৭৪৩টি ব্যারাকে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এই ব্যারাকগুলোর একটি পেয়েছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা। ব্যারাকের ২০ কক্ষের মালিকানা তাদের ২০ জনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেখানে নিজেদের মতো করে ৫০ জন বসবাস করছেন।
এর পাশাপাশি দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলার বাঙ্গি বেচা ব্রিজ সংলগ্ন পল্লীতেও আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তৃতীয় লিঙ্গের ১২৫ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সেখানে নতুন ঘরের পাশাপাশি জীবিকার উপায়ও পেয়েছেন তারা।
ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আশ্রয়ণ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যা তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ ৩ লাখ ২০ হাজার ৫২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।
এবার মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। তার এই ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা ২০২০’ প্রণয়ন করা হয়।
এ লক্ষ্যে গত বছর জুনে সারা দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা করা হয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তাদের জীবন বদলের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ভূমিহীন, গৃহহীন, অসহায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন এবং তাদের ঋণপ্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা এবং আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য।