ক্যাটাগরি

যুদ্ধাপরাধ: ময়মনসিংহের তিন আসামির আমৃত্যু কারাদণ্ড

এ মামলার নয় আসামির মধ্যে একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৪২টি মামলার ১২৪ জন আসামির মধ্যে এই প্রথম কেউ বেকসুর খালাস পেলেন।

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার।

আসামিদের মধ্যে গ্রেপ্তার পাঁচজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আর বাকি চার আসামিকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে।

পলাতক চার আসামির একজন রায় চলাকালে আদালতের বাইরে এসে ধরা দিয়েছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

এই নয় আসামি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে ময়মনসিংহের বিভিন্ন গ্রামে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মত অপরাধে যুক্ত হন বলে এ মামলায় অভিযোগ করা হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি ঘটনায় অভিযুক্ত করে ২০১৮ সালের মার্চে তাদের বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিল আদালত।

উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত বছরের ২৬ জানুয়ারি মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়।

কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে গতবছর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলারই রায় দিতে পারেনি ট্রাইব্যুনাল। শেষ পর্যন্ত গত মঙ্গলবার মামলার রায়ের জন্য এ দিন ঠিক করে দেয়।

সে অনুযায়ী এ ট্রাইব্যুনালে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার পর রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়।

আসামিদের কার কী রায়

কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে মো. শামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালামকে ১ ও ৪ নম্বর অভিযোগে এবং পলাতক এ এফ এম ফয়জুল্লাহ ও আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডলকে চারটি অভিযোগের সবগুলেতেই আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আর কারাগারে থাকা মো. খলিলুর রহমান মীরকে ১ ও ৪ নম্বর অভিযোগে; মো. আব্দুল্লাহকে ১ নম্বর অভিযোগে, মো. রইছ উদ্দিন আজাদী ওরফে আক্কেল আলীকে ১, ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে এবং পলাতক সিরাজুল ইসলাম তোতাকে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে; আলিম উদ্দিন খানকে ১, ২ ও ৩ নম্বরে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। 

এ মামলায় অভিযুক্ত অপর আসামি আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

রায়ে খালাস পাওয়া আব্দুল লতিফ

রায়ে খালাস পাওয়া আব্দুল লতিফ

মামলার নয় আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা পাঁচজনকে সকাল পৌনে ৯টায় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে আসা হয়। পরে তাদের এজলাসে হাজির করে দূরত্ব বজায় রেখে বসানো হয়। আদালতের নির্দেশে তারা একে একে নিজেদের নাম বলেন।  

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের প্রারম্ভিক বক্তব্যের পর বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ২২২ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন। রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি আমির হোসেন। সবশেষে বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম সাজা ঘোষণা করেন।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলাটি পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। এছাড়া প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, জেয়াদ আল মালুম, ঋষিকেশ সাহা, মোখলেছুর রহমান বাদল, সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নী, রেজিয়া সুলতানা চমন, তাপস কান্তি বল রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন।

আসামি আব্দুল লতিফ, মো. শামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালাম, মো. রইছ উদ্দিন আজাদী ওরফে আক্কেল আলী ও মো. আব্দুল্লাহর আইনজীবী ছিলেন আব্দুস সাত্তার পালোয়ান। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান রায়ের সময় ট্রাইব্যুনালে ছিলেন না।

রায়ের পর প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রসিকিউশন এ মামলার চারটি অভিযোগই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রসিকিউশন রায়ে সন্তুষ্ট। আর ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম খালাস পাওয়া আসামির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পর‌্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

আসামি পক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসামি আব্দুল লতিফ খালাস পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন দুটি অভিযোগ এনেছিল। দুটি অভিযোগে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার অপরাধ ছিল। কিন্তু প্রসিকিউশন এসব অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে।

“আর যে তিনজন দণ্ডিত হয়েছেন, তাদের সাথে আলোচনা করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।”

রায়ের সময় ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা কক্ষে এ এফ এম ফয়জুল্লাহ, যিনি এতদিন পলাতক ছিলেন

রায়ের সময় ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা কক্ষে এ এফ এম ফয়জুল্লাহ, যিনি এতদিন পলাতক ছিলেন

ধরা দিলেন এক পলাতক আসামি

সকালে ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরুর আগেই এক ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের গেইটে এসে দাবি করেন, তিনি এ মামলার আসামি, আদালতে আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন।

কিন্তু ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে ট্রাইব্যুনালে ঢুকতে দেয়নি। রায়ের পর ওই ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা কক্ষে বসে থাকতে দেখা যায়।

এক পর্যায়ে আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিরাপত্তা কক্ষে বসে থাকা ব্যক্তি নিজেকে এ মামলার পলাতক আসামি এ এফ এম ফয়জুল্লাহ বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আজ এখানে এসেছেন আত্মসমর্পণ করতে। কিন্তিু তাকে ট্রাইব্যুনালে ঢুকতে দেয়নি। আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার মত সামর্থ্য তার নাই।”    

ট্রাইব্যুনাল যে তিনজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে, তাদের মধ্যে এ এফ এম ফয়জুল্লাহ একজন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের উপ-কমিশনার মো. সাজ্জাদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ এফ এম ফয়জুল্লাহকে শাহবাগ থানায় পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। আমরা তাকে প্রাথমিকভাবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখাব। পরে সংশ্লিষ্ট থানায় (গফরগাঁও অথবা ভালুকা) হস্তান্তর করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”  

বিচার পরিক্রমা

২০১৮ সালে এ মামলায় মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছিল ট্রাইব্যুনাল।

অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে মো. আব্দুল মালেক আকন্দ ওরফে আবুল হোসেন ওরফে আবুল মেম্বার গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিচার চলাকালে মারা যান। আর আসামি নুরুল আমিন শাজাহান মারা যান পলাতক অবস্থায়।

২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর এ মামলার তদন্ত শুরু হয়। পরে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনে ট্রাইব্যুনাল ২৫ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের মত অপরাধের তিনটি অভিযোগ এনে ২০১৮ সালের ৪ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

অভিযোগ গঠনের পর ওই বছরের ১০ মে থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ ও শুনানি শুরু হয়। মোট ১৮ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।

সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্ক শুরু হয়ে শেষ হয় গত বছরের ২৬ জানুয়ারি। ওই দিনই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষায় রাখা হয়।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজশাহীর বোয়ালিয়ার সাবেক শিবির নেতা মো. আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতানের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় এসেছিল ট্রাইব্যুনালে। সেই রায়ে টিপু সুলতানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় যুদ্ধাপরাধ আদালত।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৪২টি মামলার ১২৪ জন আসামির মধ্যে ১২ জন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ১১১ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৬৯ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে। এ পর্যন্ত খালাস পেয়েছেন একজন।

পুরনো খবর


মহামারীকালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায়হীন বছর
 


যুদ্ধাপরাধ: ময়মনসিংহের ১১ জনের বিচার শুরু


রাজশাহীর টিপু রাজাকারের ফাঁসির রায়