ক্যাটাগরি

যুদ্ধাপরাধ: ৪২ রায়ে প্রথম আসামির খালাস

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মত যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার দায়ে বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও ভালুকার তিন আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং পাঁচ আসামিকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ আদালত।

অভিযোগে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলার আসামি মো. আব্দুল লতিফকে রায়ে খালাস দেওয়া হয়েছে।

মামলার নথিতে বলা হয়েছে, আব্দুল লতিফের জন্ম ১৯৫৯ সালে ২৬ জুন, বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার তললী গ্রামে।

প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে যে অভিযোগপত্র দিয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আব্দুল লতিফ। গফরগাঁওয়ের নিগুয়ারি ইউনিয়নের রাজাকার বাহিনীর তালিকায় ২৮৩ নম্বরে তার নাম পাওয়া যায়।

২০১৪ সালে যখন এ মামলার তদন্ত শুরু হয়, সে সময় তিনি গফরগাঁও উপজেলা ওলামা লীগের সহসভাপতি এবং নিগুয়ারি ইউনিয়ন ওলামা লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

রায়ে আদালত বলেছে, মো. আব্দুল লতিফ বিরুদ্ধে আনা হত্যা, অপহরণ, অবৈধভাবে আটক, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মানবতাবিরোধী অপরাধের যে দুটি অভিযোগ আনা হয়েছিল, তা থেকে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে খালাস দেওয়া হল।

তার নামে যদি আর কোনো মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না থাকে, তাহলে আদেশ পাওয়ার পর তাকে মুক্তি দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৪২টি মামলার ১২৪ জন আসামির মধ্যে এই প্রথম কেউ বেকসুর খালাস পেলেন।

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার।

আসামিদের মধ্যে লতিফসহ পাঁচজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আর বাকি চার আসামিকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে। তাদের মধ্যে একজন আবার রায়ের সময় আদালতের বাইরে এসে ধরা দেন।

খালাসের বিষয়ে আব্দুল লতিফের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মূলত দুইটা (অভিযোগ-৩ ও ৪)। তিন নম্বর অভিযোগে তারু খা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই তারু খা হত্যার ব্যাপারে নথি দাখিল করে দেখিয়েছি, ১৯৭২ সালে সালে তারু খাকে হত্যার জন্য তার ছেলে আফাজ উদ্দিন একটি মামলা করেছিলেন ৯ জনের বিরুদ্ধে। সেই মামলাটির দালিলিক গুরুত্ব অনেক বেশি। সেখানে আব্দুল লতিফের নাম ছিল না।

“এছাড়া আমরা ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের দাখিল করা নথি থেকেই দেখিয়েছি যে ১৯৭২ সালে এই আসামির বয়স ছিল ১১ বছর। ১১ বছরের একটি ছেলে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে পারে না। যোগ দেওয়ার কোনো সুযোগও নাই। আদালত এই দুইটা বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে আব্দুল লতিফকে দুটি অভিযোগ থেকেই খালাস দিয়েছে।”

তিনি বলেন, “ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় খালাস পেলেন।”

প্রসিকিউশন যুক্তিতর্কে শেষে দাবি করেছিল আসামিদের বিরুদ্ধে সবকটি অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু রায়ে এক আসামিকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশন এ রায়ে সন্তুষ্ট কিনা বা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে কিনা জানতে চাইলে মামলার প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রসিকিউশন এ মামলার চারটি অভিযোগই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রসিকিউশন রায়ে সন্তুষ্ট। আর ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম খালাস পাওয়া আসামির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল বলেন, “রায় পড়ার সময় যখন শাস্তির অংশটুকু পড়া হচ্ছে, তখন মাননীয় ট্রাইব্যুনাল বারবারই যে শব্দগুলোর ওপর জোর দিয়েছেন- সেটি হচ্ছে এইডিং অ্যান্ড অ্যাবেটিং (সহায়তা এবং প্ররোচনা)।”

এ মামলায় যাদের আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, অপরাধের সাথে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে তাদের ‘সহায়তা ও প্ররোচনা’ জন্য বিভিন্ন ওই সাজা হয়েছে। তাদের সরাসরি অংশগ্রহণের বিষয়টি আসেনি।

তাপস বলেন, “সহায়তা এবং প্ররোচনা দুই ধরনের হতে পারে। যখন কোনো আসামি প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান আর্মিকে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে কিন্তু পাকিস্তান আর্মির চাইতেও যিনি দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বা ধরিয়ে দিচ্ছেন তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ না হলে পাকিস্তান আর্মি হয়ত ভিকটিমের কাছে পৌঁছাতে পারত না। ফলে যিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বা দেখিয়ে নিয়ে গেছেন তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে।

“আবার কোনো ব্যক্তি অপরাধী চক্রের কোনো একটা জায়গায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন, অতটা গুরুতর ভূমিকা পালন করেননি, তার বা তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু সাজা অতটা গুরুতর হবে না। বিভিন্ন মেয়াদে হবে। এখন কার কী ভূমিকা ছিল তার প্রমাণ নির্ভর করে সাক্ষ্যের ওপর। সাক্ষী যেভাবে বলেছে, প্রসিকিউশন সেভাবেই ট্রাইব্যুনালে সাবমিট করেছে।”